নিজস্ব প্রতিবেদক
গণঅভ্যুত্থানগাথা
সন্তানের উৎসুক চোখ খুঁজে কেবল বাবাকেই

বাবা শহীদ হওয়ার পর থেকে ছেলে-মেয়ে দুটি কিছু খেতে চায় না। কথাও বলে না ঠিকমতো। সবসময় মন খারাপ করে থাকে। মাঝে মাঝে বাবার কথা মনে করে কাঁদতে শুরু করে। কথাগুলো বলছিলেন শহীদ মো. আবদুল জব্বারের স্ত্রী সুমাইয়া ইসলাম সুমি।
তিনি জানতে চান, আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল? আমাকে কেন বিধবা হতে হলো? আমার ছেলে-মেয়েকে কেন বাবাহারা হতে হলো? তিনি তার স্বামী হত্যার বিচার চান।
রাজধানীর মহাখালীতে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ক্ষুদ্ধ সুমি একের পর এক প্রশ্ন করেন, আমাদের সুখের সংসারে এমন পরিস্থিতি কেন হলো?
সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা কে দেবে? আমার সংসার কীভাবে চলবে? আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? কীভাবে চলবে আমার ও ছেলে-মেয়ের জীবন?
আবদুল জব্বার তিতুমীর সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেন। তিনি রাজধানীর মেরুলবাড্ডা এলাকায় এসিআই কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরি করতেন।
দুই সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে ছিল তার সংসার। জব্বার গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মেরুলবাড্ডার সিরাজ মিয়া স্কুলের সামনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। তাকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব তার পরিবার।
কান্না থামছে না স্ত্রী, সন্তান ও তার মায়ের। দুই শিশু সন্তানের উৎসুক চোখ এখন কেবল বাবাকেই খোঁজে। বাবার বয়সি কাউকে দেখলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তারা। এদিকে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন তাদের মা সুমি।
জানা গেছে, আবদুল জব্বারের (৪০) গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সদর উপজেলার মহব্বতপুর গ্রামে। তার পিতা মৃত আবদুল মতিন এবং মা নাজমা বেগম। জব্বার এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক ছিলেন। ছেলে সামি ইসলামের বয়স ১২ এবং মেয়ে নুজাইফা ইসলামের বয়স (৪) বছর। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন আবদুল জব্বার।
গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডার সিরাজ মিয়া স্কুলের সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবদুল জব্বার। তিনি মেরুল বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। পরে ৬ আগস্ট মহাখালীর রহিম মেটাল কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সুমাইয়া ইসলাম সুমি বলেন, বাচ্চাগুলো সবসময় মন খারাপ করে থাকে। কিছু খেতে চায় না, বাবার কথা মনে হলেই কান্না শুরু করে। ওর বাবা যে আর ফিরবে না, আল্লাহর দরবারে চলে গেছে, সেটা কোনোভাবেই তারা বুঝতে চায় না। কী করব ওদের নিয়ে, জানি না। আসলে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি অনেক বেশি চিন্তিত।
তিনি বলেন, ওদের বাবা ছোট একটা চাকরি করতেন। যা বেতন পেয়েছেন, তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতেন। সঞ্চয় করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বাসাভাড়া, বাজার খরচ, ছেলের লেখাপড়ার খরচ। কত টাকা লাগে তাতো সবার জানা।
তিনি বলেন, আমার শাশুড়ি অসুস্থ মানুষ। তার জন্য ওষুধ কিনতে হয়। আগামী বছর মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে, কিন্তু স্কুলের বেতন কীভাবে পরিশোধ করব?
বাসাভাড়া কীভাবে দেব? বাজার খরচ কীভাবে চলবে? জব্বারের আয়েই চলতো আমাদের সংসার। আমি কোনো উপায় না পেয়ে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এতে আর কয় টাকা আয় হবে? এই টাকা দিয়ে তো আর সংসার চলবে না। কীভাবে যে কী হবে আল্লাহ জানেন।
শহীদ আবদুল জব্বারের বড় ভাই রাশেদ খান বলেন, আমার ভাই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন। তার এক ছেলে, এক মেয়ে রয়েছে। তাকে হারিয়ে পরিবার এখন দিশাহারা। কীভাবে তাদের সংসার চলবে এ চিন্তায় চোখে অন্ধকার দেখছে তারা। আমিও ছোট একটা চাকরি করি। আমি তো চাইলেই সবসময় সহযোগিতা করতে পারব না।
তিনি বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা বলে বুঝানো যাবে না। ছোট ভাইটার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও মা সবসময় মন খারাপ করে থাকে। ভাতিজা-ভাতিজির মুখের দিকে তাকাতে পারি না। ছোট ছেলেটাকে হারিয়ে আম্মাও সবসময় কান্নাকাটি করেন। আর কোনো পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শহীদ জব্বারের স্ত্রী সুমি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন। শেখ হাসিনার পালানোর খবর শুনে বিকেলে আমার স্বামী বিজয় মিছিলে যায়। পরে বিকেল ৫টার দিকে বাসায় ফিরে ছেলে-মেয়ের সঙ্গে নাস্তা খেয়ে মাগরিবের নামাজ পড়তে বের হন।
এর পরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম। রাত ১২টা বেজে যায় খবর পাই না। তখন সবাই মিলে তাকে খুঁজতে বের হই। পরে বাসার নিচের একজন বলেন, ‘জব্বার ভাইয়ের শরীরে গুলি লাগছে সন্ধ্যা ৭টার দিকে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেছে।’ পরে আমরা ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করি।
শেষপর্যন্ত পাই তার লাশ। জব্বারের পেটে গুলি লেগেছিল। পরে ঢাকা মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে আসি এবং ৬ আগস্ট বাদ মাগরিব জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।
শহীদ জব্বারের বড় ভাই রাশেদ খান বলেন, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেন হাজার হাজার মায়ের বুক খালি না হয়। যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
একইসঙ্গে এই আন্দোলনে সারা দেশের যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন করার দাবি জানান রাশেদ খান।
কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে জব্বারের স্ত্রী বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। পাঁচ লাখ টাকা দ্রুতই দেবে বলে জানিয়েছে। এ ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।
"