ছায়েদ আহামেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী)
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া
সব বই পায়নি শিক্ষার্থীরা টেনেটুনে চলছে ক্লাস

নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া। প্রতি বছরের প্রথমদিন ঘটা করে বই উৎসব করা হত। শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যের নতুন বই পেয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরত। তবে এ বছর ব্যতিক্রম। নতুন বছরের প্রথম মাস শেষ হলেও এ উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সব বই পায়নি। প্রতিশ্রেণির শিক্ষার্থী ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩টি বই পেয়েছে। এগুলো দিয়েই টেনেটুনে চলছে পাঠদান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণের এ চিত্র হাতিয়ায় কিছুটা ব্যতিক্রম। নোয়াখালী জেলার অন্য উপজেলায় যে পরিমাণ বই পৌঁছেছে একই জেলার অধীনে থাকা হাতিয়ায় কিন্তু ওই পরিমাণ বই আসেনি-এমন অভিযোগ তুলেছেন অনেক শিক্ষক।
এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরুর আগেই, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তবে এখনো যে পরিমাণ বই ছাপানোর বাকি, ঈদের ছুটির আগে
সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া বেশ কঠিন হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বই না থাকায় হাতিয়ার বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি একেবারে কমে গেছে। যারা আসে তারা খেলাধুলা করে দুপুর পর্যন্ত কাটায়, তারপর ছুটি।
গতকাল সরেজমিনে হাতিয়ার ৯টি বিদ্যালয় ও ৩টি মাদরাসায় গিয়ে দেখা গেছে, কোনো মাদরাসা কিংবা বিদ্যালয়েই সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন বই পায়নি। মাধ্যমিকে তিনটি বিষয় আর ৮ম-এ মাত্র দুইটি বিষয়ের বই বিতরণ করা হয়েছে। মাদরাসায় ৮ম শ্রেণিতে কোনো বই-ই পায়নি। প্রাথমিকেও একই অবস্থা। কেবল ১ম, ২য় এবং তৃতীয় শ্রেণির বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় মাদরাসা ও বিদ্যালয়ে একটি বা দুটি করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। বই না থাকায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারে কম। তারা ক্লাসে মনোযোগী হচ্ছে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে পুরোনো বই দিয়ে টেনেটুনে দু-একটি ক্লাস করানো হচ্ছে।
উপজেলার পশ্চিম লক্ষ্মীদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ কপি সংগ্রহ করে পড়ানোর চিত্র দেখা গেছে। পিডিএফ কপি’র সাপোর্ট নেওয়ার বিষয়ে রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহেনা আক্তার এবং হাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রওশনারা বলেন, এ ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা পাননি।
আবার প্রধান সড়ক থেকে দূরবর্তী উত্তর-পশ্চিম গুল্যাখালী হাজি গিয়াসউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও দেখা যায়নি। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আবদুল কাদের বলেন, আমরা কোনো বই পায়নি, তাই ছাত্র-ছাত্রী আসে না। তিনি আরো বলেন, আমাদের জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায় সব বই পেয়েছে, কিন্তু আমরা পাইনি। তাই ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না। একই অবস্থা মধ্যচর আমানুল্যাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। এখানেও কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা যায়নি। এমন কিছু চিত্র প্রায় নব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে লক্ষ্য করা গেছে।
মো. মফিজ উদ্দিন আহামদ নামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক তার ফেসবুকে লিখেছেন- ‘দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে সব শ্রেণির বই পেয়ে গেছে! অথচ আমরা পেয়েছি ১ম-৩য়! এটা বৈষম্য না?’
একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নব সরকারিসহ প্রায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বই না থাকার অজুহাতে পাঠদান দূরের কথা, স্কুলেও ঠিকমতো আসেন না। তাদের ছাত্র-ছাত্রীও নেই। আর আমরা নতুন পুরান বই দিয়ে ঠিকমতো পাঠদান চালিয়ে নিচ্ছি।’
এদিকে বুড়িরচর ছৈয়দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির তামান্না এবং জেসমিন নামে দুই শিক্ষার্থী বলেন, আমরা তিন বিষয় নতুন পেয়েছি। তবে নতুন-পুরান বই মিলিয়ে আমাদের দুই-তিন বিষয়ের ক্লাস হয়। আবদুল মোতালেব উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইফফাত আরা, মাহি ও সানজিদা বলেন, এখন বিভিন্ন ইভেন্টের খেলাধুলা চলে, আর সব বই না পাওয়াতে এক-দুইটা বিষয়ের ক্লাস হয়।
রিয়াজ উদ্দিন নামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, এখনতো খেলাধুলার সময়, আর বই যা আছে তা দিয়ে এক-দুইটা ক্লাস করানো হয়। আকতার হোসেন নামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক জানান, আমরা তিনটা বিষয়ের বই পেয়েছি, আর ৮ম শ্রেণির মাত্র ২টা বিষয়ের বই পেয়ে কোনোমতে ক্লাস চালিয়ে নিচ্ছি। সোহেল নামের আরেক শিক্ষক জানান, বই না পাওয়ার কারণে ঠিকমতো পাঠদান করা যাচ্ছে না, বিষয়টির সমাধানে এনসিটিবির জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তমরোদ্দি আহমাদিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাইন উদ্দিন জানান, ৮ম শ্রেণির কোনো বই পায়নি আর অন্য শ্রেণির তিনটি বিষয়ের বই পেয়েছি।
জহির উদ্দিন ও মাইন উদ্দিন নামের দুইজন ছাত্রের অভিভাবক হাতাশা জানিয়ে বলেন, বছরের প্রথম মাস শেষ হয়ে গেল অথচ আমাদের সন্তানরা এখনো বই পেল না। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যেমন কমে যাবে, তেমনি পড়াশোনার ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে যাবে।
জানা যায়, হাতিয়ায় এবতেদায়ী ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ১৭টি মাদরাসায় শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৯ হাজার। দুটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ ৩৪টি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২২৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৬৩ হাজার ৭০০ জন। যেখানে শিশু শ্রেণিতে সাত হাজার ৫০০ জন, প্রথম শ্রেণিতে ১২ হাজার ৩০০ জন, ২য় শ্রেণিতে ১৩ হাজার ৫০০ জন, ৩য় শ্রেণিতে ১১ হাজার ৫০০ জন, ৪র্থ শ্রেণিতে ১০ হাজার ৮০০ জন এবং ৫ম শ্রেণিতে ৮ হাজার ১০০ জন শিক্ষার্থী।
হাতিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আ. জব্বার বলেন, বইয়ের বিষয়টি জেলা সমন্বয় মিটিংয়ে বলা হয়েছে। এখনো পুরো সেটের প্রিন্টিং শেষ হয়নি। তাই সব শ্রেণির বই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কবেনাগাদ সবগুলো বই আসবে সে বিষয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেননি এ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনছুর আলী চৌধুরীর মোবাইল ফোনে বারবার কল দিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি।
"