মিজান রহমান
রাজনীতিতে সুফল পেতে সক্রিয় ইসলামি দলগুলো

কদর বেড়েছে ইসলামি দলগুলোর। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের হিসাবনিকাশ যত এগিয়ে আসছে, বড় দলগুলোর মধ্যে বিরোধ তত প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার লড়াইয়ে এতদিন যে দলগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছে, তারাই শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় এসে একে অন্যকে নিশানা বানাচ্ছে। দলগুলোর মধ্যে বুঝ-পরামর্শে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমন ক্রমবর্ধমান বৈরী পরিবেশের মধ্যে কদর বাড়ছে ইসলামি দলগুলোর। সম্প্রতি বিএনপি এবং একসময় তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করা জামায়াতে ইসলামীর নানা কর্মকাণ্ডে তা প্রমাণ হচ্ছে। দেশের ইসলামি দলগুলোর নেতারা চিন্তা করছেন ইসলাম-পছন্দ দলগুলোর ভোট এক বাক্সে আনতে পারলে সংসদ নির্বাচনে বড় সুফল পাবেন তারা।
সূত্র জানায়, সমমনা ‘জোট’ ও ‘দল’-এর বাইরের ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব সংগঠনকে নিয়ে এবার নির্বাচনী ছক কষছে বিএনপি। এক্ষেত্রে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোও রয়েছে দলটির লক্ষ্যে। অন্যদিকে জামায়াতও নানা কৌশল ও ছক আঁটছে নির্বাচন ঘিরে। মান-অভিমান ভুলে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে দলটি। তারা ইসলামী মানসিকতার ভোটারদের ভোট এক বাক্সে আনার চেস্টা করছেন।
বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়েছে সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের বৈঠক এবং বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যের পর। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেছেন চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীমের সঙ্গে। এর আগে চরমোনাই পীরের বরিশালের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। এ ছাড়া বিএনপি খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ছোট ছোট ইসলামি দলকে পক্ষে আনার জন্য বড় দলগুলোর এমন তৎপরতা চলছে। এতে রাজনীতির মাঠে কদর বাড়ছে এসব দলের।
বিএনপি দেশব্যাপী তাদের নির্বাচনী তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে। সূত্র জানায়, এর মধ্যেই ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। কিন্তু ছোট দলের অধিকাংশই আগামী নির্বাচনে তাদের আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনই নিশ্চিত করতে আগ্রহী। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ভেতরে ভেতরে তাদের আলাপ-আলোচনাও চলছে।
তথ্যমতে, সপ্তাহখানেক আগে জামায়াতে ইসলামীর আমীর বৈঠক করেন ইসলামী আন্দোলনের আমীরের সঙ্গে। ওই বৈঠকের পর ইসলামী আন্দোলনের নেতারা ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরির প্রচেষ্টার কথা জানান।
এদিকে গত সোমবার ইসলামী আন্দোলনের আমীরের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির দিক থেকে এ বৈঠকের লক্ষ্য, দূরত্ব কমিয়ে এনে সম্পর্কোন্নয়ন। তবে এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মাঠে-ময়দানে বিএনপির সমালোচনা করে দেওয়া দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য থামানো। ওই বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গও এসেছে।
নির্বাচনের সময় নিয়ে পুরোপুরি একমত না হলেও ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়াসহ ১০টি বিষয়ে একমত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দল দুটি। বৈঠক শেষে বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের ঘোষণায় দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমানোরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘সংস্কার ও নির্বাচন’সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে যে কয়টি রাজনৈতিক দলের মতবিরোধ সামনে আসে, এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন অন্যতম। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে ‘দখল, চাঁদাবাজি’ নিয়ে জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিকে লক্ষ্য করে বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম ও জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ফয়জুল করীম শরীয়তপুরে এক সমাবেশে অভিযোগ করেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চিহ্নিত একটি দল লুটপাট, খুনখারাপি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে। চলতি মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের মানুষ আর চাঁদাবাজ, দখলকারী, খুনিদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে কর্মসূচিতে তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একক বাক্স দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। এ বক্তব্যগুলো বিএনপিকে নিশানা করেই বলা হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছিল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের লক্ষ্য ছিল, নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ধরনের বক্তব্য থামানো। বৈঠক শেষে দল দুটি এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছারও ঘোষণা দিয়েছে। যৌথ বৈঠকে যে ১০ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন ও বিএনপি একমত হয়েছে, এর মধ্যে ৭ নম্বরে ছিল এটি। তাতে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা বলব না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়নি।
এ ছাড়া নির্বাচনের সময় নিয়েও দল দুটিতে কিছুটা মতপার্থক্য হয়। ইসলামী আন্দোলন আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে। বিএনপির নেতারা এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, এতে আসনভিত্তিক প্রার্থী থাকবে না। ফলে মানুষ ভোটের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠবে।
এ ছাড়া বিএনপি চলতি বছর জুলাই-আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে। ইসলামী আন্দোলন প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। এ বিষয়ে যৌথ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, আমরা ‘দ্রুত সময়’ শব্দটি ব্যবহার করেছি এবং বেশি সময় না নিয়ে যৌক্তিক, সেই যৌক্তিক সময়টা আমরা বলেছি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে। ছয় মাস তো প্রায় চলেই গেল। আর এক বছরের মধ্যেই সুন্দর একটা জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে, এটাই মূলত আমাদের কাম্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরকে আক্রমণ করে দেওয়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের বিষয়টি আলোচনায় এলে জামায়াতের প্রসঙ্গ ওঠে। তখন বিএনপি নেতারা বলেন, এটি চলতে থাকলে পতিত আওয়ামী লীগই এর সুবিধা পাবে। সে সময় ইসলামী আন্দোলনের উচ্চপর্যায়ের এক নেতা বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে তো আপনারাই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, মন্ত্রী বানিয়েছেন। জবাবে বিএনপির এক নেতা বলেন, সেটা আমাদের ভুল হয়েছে।
এ বৈঠকে থাকা ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম মেম্বার আশরাফ আলী আকন বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। আমরা জামায়াতের সঙ্গে কিছু কমন ইসুতে একমত হয়েছি- যেমন সংস্কার আগে, পরে নির্বাচন। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন। এ ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একক বাক্স দেওয়ার প্রচেষ্টাও চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হলো। আমরা ১০টি বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত হয়েছি।
এর আগে ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বরিশালে দলীয় এক সমাবেশে গিয়ে চরমোনাই পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও দুই দলের শীর্ষ নেতাদের ওই সাক্ষাৎ বা বৈঠকের ঘটনা দেশের ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাজনীতিতে কৌতূহলের সৃষ্টি করে।
এর আগে ২২ জানুয়ারি খেলাফত মজলিসের আমীর, মহাসচিবসহ নয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। আরো কিছু দলের সঙ্গেও বিএনপির বৈঠক করার কথা রয়েছে।
রাজনৈতিক মহল মনে করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে জামায়াতের পাল্লা ভারি করার চেষ্টার বিপরীতে বিএনপি এই বৈঠক শুরু করেছে। যদিও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায়ের আন্দোলনে যেসব দল রাজপথে ছিল আমরা সবাইকে নিয়ে আগামীতে নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও বৈঠক করে চলছি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল এবং সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদ কখনো মেনে নেবে না। আমরা সবাই ঐক্যমতের ভিত্তিতেই চলতে চাই। যারা কিছু কিছু সুবিধা নিচ্ছেন, তারা আমাদের সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন চাই, তা হবে সুষ্ঠুভাবে, সঠিকভাবে। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাংলাদেশে সরকার গঠন করতে চাই।’
"