জাহিদুল হাসান, জবি
হাসিনার পাওয়ার হাউস ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

হাসিনাযুগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আয়োজন হত আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে। সারা বছরের আয়োজন হত আগস্ট মাসকে কেন্দ্র করে। আগস্ট মাসের শোকসভাতে যে শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তার বক্তব্যের পারফরম্যান্স ভালো হত তারই মিলত পদোন্নতি। মতের বিরুদ্ধে গেলেই যেকোনো শিক্ষার্থীকে প্রশাসনের সহায়তায় ক্লাস কিংবা পরীক্ষার হল থেকে বের করে ছাত্রলীগের নেতারা করতেন মারধর। মারধর শেষে খোদ প্রক্টর অফিসে প্রক্টর এবং সহকারী প্রক্টর মিলে মোবাইল ফোন জব্ধ করে দিয়ে দিতেন পুলিশের হাতে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে স্বল্প সময়ে পদোন্নতি, ভুয়া পিএইচডি সার্টিফিকেট, জালিয়াতি, অন্যায়ভাবে বেতন বৃদ্ধি, নানা দপ্তরে নিয়োগ ও বদলি করত একটা দলীয় সিন্ডিকেট। এর হোতা ছিলেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।
২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩৮টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট থেকে নিজ নিজ বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ৬৫ জন শিক্ষার্থী। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সাতশ’র অধিক শিক্ষক আছেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকাই ছিল এদের নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা। পরীক্ষায় সর্বোচ্চ অবস্থান নিয়েও বহু শিক্ষার্থীর ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ এবং পরিবারের কেউ আওয়ামী মতাদর্শের না হওয়াতে শিক্ষক হওয়ার আবেদন খারিজ হত। আওয়ামীপন্থি প্রায় ৬০০ শিক্ষকের মধ্য থেকে শতাধিক শিক্ষক পাঠদানের চেয়ে সরকারের তোষামোদিতে নিয়োজিত থাকতেন। প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে ক্লাসরুম, অডিটোরিয়ামসহ বিভিন্ন জায়গায় চলত আওয়ামী প্রচারণা। আওয়ামীপন্থি অধিকাংশ শিক্ষক বরাদ্দকৃত ক্লাস না নিয়েই পরীক্ষা নিতেন। তাদের কাজই ছিল শেখ হাসিনার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া। এসবই চলত সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে। এদের অনেকে গবেষণা বাদ দিয়ে সরকারের গুণকীর্তন করে পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখতেন। এভাবেই উপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। গত ৫ আগস্টের আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে প্রথমেই তা প্রক্টরের কার্যালয়ের ফাইলে জমা পড়ত। তারপর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি তৈরি করা হত। কিন্তু দেখা যেত, এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত না। এমনকি তদন্তের পুনরায় তদারকি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিচার পাওয়া যেন সোনার হরিণ ছিল। বেছে বেছে দলীয় অনুগতদের ভিসি নিয়োগ দেওয়া হত। তৎকালীন প্রতিটি ভিসি যেকোনো অনুষ্ঠানে ভাষণ শুরু করতেন শেখ মুজিবুর রহমানের কথা দিয়ে আর শেষ করতেন শেখ হাসিনার উন্নয়ন দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন করার চেয়ে আওয়ামী নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। হাসিনার সরকারের যুগে সর্বশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। তিনি ছিলেন আওয়ামী উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। তার বিরুদ্ধে গবেষণাপত্র চুরির অভিযোগ রয়েছে। তবুও তাকে জবি উপাচার্য পদ দেওয়া হয় শুধু দলীয় আনুগত্যের কারণে। সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের নির্দেশে তৎকালীন পরিবহন পুলের দায়িত্বে থাকা সিদ্ধার্থ ভৌমিকের নির্দেশে ১৫ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়িবহরে অসংখ্য ছাত্রলীগ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। হামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা আহত হয়। এর আগে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ২০১৩ সালের ২০ মার্চে জবির ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান। তারপর দ্বিতীয় মেয়াদেও ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৭ সালের ২০ মার্চ। দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত বক্তব্য দিতে থাকেন। এক বেসরকারি টেলিভিশনে টকশোয় তিনি বলেন, যুবলীগের দায়িত্ব পেলে তিনি উপাচার্য পদ ছেড়ে দেবেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যদি দায়িত্ব দেন তাহলে তিনি জবি উপাচার্য পদ ছেড়ে দিয়ে যুবলীগের পদে দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে সাবেক এ ভিসির আমলেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠক মাসুদ রানা বলেন, গত সরকারের আমলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ছিল। রেজিস্ট্রার দপ্তর অথবা প্রশাসনিক দপ্তরে কাজে যদি শিক্ষার্থীরা যেত তাহলে বলত লাঞ্চের পরে আসেন। লাঞ্চের পরে গেলে বলত আগামীকাল আসেন, আগামীকাল গেলে বলত, পরের দিন। এভাবে নানাভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হত। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস এবং আবাসনের নামে চলে কোটি কোটি টাকার লুটপাট। ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিলেন জিম্মি। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, বিগত সরকারের আমলে শুধু আওয়ামী মতাদর্শের শিক্ষক নিয়োগ দিলেও এখন আর সেটি হবে না। এখন থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। কোনো দলীয় দিক বিবেচনা করা হবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ যদি শিক্ষক হওয়ার যোগ্য থাকে অবশ্যই তাকে প্রথমে বিবেচনা করা হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এখনো ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, প্রায় তিন মাস আগেই কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে বলা হয়েছে ৪৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। তারা অন্যান্য কাজের চাপের কারণে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত বেআইনি এবং সহিংস ঘটনায় জড়িত জবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার তেমন কোনো নির্দিষ্ট সময় পাননি। তিনি আরো বলেন, এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ না হওয়ায় ব্যর্থতা আমাদের। আশা করছি এ বিষয়ে আমরা দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করব।
"