প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫

ঐতিহ্য

কেউ আর জিজ্ঞাসা করে না আম্মু, কিছু লাগবে কিনা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আকরাম খান রাব্বি স্বপ্ন দেখতেন, তার কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে বাবা ও মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবেন। বাবা ও মায়ের স্বপ্ন পূরণের পথেই ছিলেন রাব্বি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা চাকরি করতেন। কিন্তু বুলেটের আঘাতে তার সেই যাত্রা থেমে গেছে চিরতরে। রাব্বির মা বিউটি আক্তার কন্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলের মা ডাক এখনো কানে বাজে। এখন আর কেউ মায়াভরা কণ্ঠে জিজ্ঞাস করে না, মা! তোমার কিছু লাগবে কিনা। খবর বাসস।

গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রাব্বি। শেষবারের মতো তার মুখটাও দেখতে পারেননি কেউ।

রাজধানীর মিরপুর ১৩-এর কাফরুল থানার ৪নং ওয়ার্ডের পূর্ববাইশটেকের বাসায় আলাপ হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আকরাম খান রাব্বির পিতা মো. ফারুক খানের সঙ্গে।

শহীদ আকরাম খান রাব্বির বয়স হয়েছিল ২৮ বছর। তিনি রাজধানীর ক্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। পাশাপাশি ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়ের শোরুমে চাকরি করতেন। রাব্বির বাবা ফারুক খান ও মা বিউটি আক্তার। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাব্বি ছিলেন মেজ। বড় ভাই ব্যবসায়ী ইমরান খান রকি আর ছোট ভাই মেহেদী হাসান রাফি। রাফি এ বছর এইচএসসি পাস করেছেন। রাব্বি ১৯ জুলাই শহীদ হলেও তিন দিন পর ২১ জুলাই সন্ধ্যায় মিরপুরের পূর্ববাইশটেক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

রাব্বির পিতা ফারুক খান বলেন, ‘আমার ছেলে শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিল। অফিসের ফাঁকে ফাঁকে আন্দোলনে যোগ দিত। সে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে আন্দোলনকারীদের পানি, বিস্কুটসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার কিনে খাওয়াতো।’

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। রাব্বি দুপুরে বাসা থেকে জুমার নামাজ পড়তে বের হয়। নামাজ শেষে আন্দোলনে যোগ দেয়। বিকেল ৪টা ১৭ মিনিটে মিরপুর ১০-এ শহীদ আবু তালেব স্কুলের সামনে তার পেটে ও বুকে গুলি লাগে। সাড়ে ৪টার দিকে ওর বন্ধু আমাকে ফোন করে জানায়, রাব্বির গুলি লাগছে।

আমরা ওকে ১১ নম্বরের ইসলামিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তখন আমি বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর ১১ নম্বরের দিকে যেতে থাকি, এ সময় তার বন্ধু আবার আমাকে ফোন করে জানায়, এ হাসপাতালে রাব্বিকে চিকিৎসা দেবে না। তাই ওকে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি ঢাকা মেডিকেলে আসেন। আমি যখন অনেক কষ্ট করে ঢাকা মেডিকেলে যাই, গিয়ে দেখি আমার বাবাটার লাশ ফ্লোরে পড়ে আছে। ওর গায়ের গেঞ্জিটা রক্তে ভেজা।’ ফারুক খান আরো বলেন, ‘আমি লাশ নিয়ে আসতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে আমার ছেলের লাশ দিতে আস্বীকৃতি জানায়।’

তারা বলেন, ‘উপরের নির্দেশ আছে, লাশ এখন দেওয়া যাবে না।’ তখন আমি ৫ হাজার টাকা দিয়ে লাশ হিমঘরে রেখে রাতে বাসায় ফিরে যাই। পরের দিন ২০ তারিখ সকালে লাশ নিতে এসে দেখি রাব্বির লাশ বাইরে পড়ে আছে। লাশ নেওয়ার জন্য আমি ২০ তারিখ সারাদিন অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। অবশেষে ২১ তারিখ অনেক চেষ্টা করে, আমি রাব্বির লাশ বুঝে পাই। তিন দিন বাইরে পড়ে থাকার কারণে লাশ পচে গিয়ে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় জানাজা শেষে, মিরপুরের পূর্ববাইশটেক কবরস্থানে রাব্বিকে দাফন করা হয়।

রাব্বির বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ছেলে হারানোর যন্ত্রণা কী, আমি এখন বুঝতে পারছি। আমার কষ্ট, বিদায়বেলায় আমার সন্তানের মুখটাও কেউ দেখতে পারল না।

রাব্বির লাশ হিমঘরে রাখার জন্য আমি টাকা দিয়ে এলাম, কিন্তু লাশ বাইরে ফেলে রাখা হলো। তিনটা দিন আমার বাবাটার লাশ বাইরে পড়ে ছিল। এমন কী যখন আমি সন্তানের জানাজায় দাঁড়িয়েছি, তখন পুলিশ এসেছিল আমাকে গ্রেপ্তার করতে। স্থানীয় জনগণের বাধায় আমাকে সেদিন পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

শহীদ আকরাম খান রাব্বির মা বিউটি আক্তার বলেন, ‘শুরু থেকেই রাব্বি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ১৮ তারিখ দুপুরে বাসায় আমরা একসঙ্গে ভাত খাই। এরপর বিকেলে সে গিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতাকে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে পানি কিনে খাওয়ায়। রাতে বাসায় ফিরে আমাদের কাছে এ বিষয়ে গল্প করে। আমি ও ওর আব্বু আন্দোলনে অংশ নিতে নিষেধ করি। পরের দিন ১৯ জুলাই দুপুরে জুমার নামাজ পড়তে রাব্বি বাসা থেকে বের হয়। সাড়ে ৪টার দিকে ওর আব্বুর ফোনে এক বন্ধু জানায়, রাব্বির গুলি লাগছে। তখন ওর আব্বু তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমি ওর আব্বুকে বলি আমার বাবাটার কী হয়েছে, কোথায় গুলি লাগছে? ওর আব্বু আমাকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। একটু পরে রাব্বির বন্ধু ফোন করে আমাকে বলে, ‘আন্টি চিন্তা করবেন না, রাব্বির হাতে গুলি লাগছে।’

তিনি বলেন, সারা বিকেল চলে গেল, রাত ১১টা বেজে যায়, আমি আমার বাবাটার কোনো খবর পাই না। রাত ১২টার দিকে ওর বাবা বাসায় ফেরে। আমি দরজা খুলে দিতেই ওর বাবার গা থেকে আতরের গন্ধ পাই। তখন আমি বুঝে ফেলি আমার বাবা আর নেই। তারপরও রাব্বির বাবাকে বলি তোমার শরীরে আতরের গন্ধ কেন? তাহলে আমার রাব্বি কি আর নেই? তখন ওর বাবা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। পরে তিন দিন অপেক্ষা করি, ছেলের লাশের জন্য, আমার বাবাটাকে একনজর দেখার জন্য। সবাইকে কত অনুরোধ করলাম আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে, কিন্তু কেউ আমাকে মেডিকেলে নিয়ে গেল না। পরে ২১ তারিখে যখন শুনলাম আজ আমার বাবার লাশ নিয়ে আসা হবে। তখন আমি সকাল থেকে বাসার নিচে অপেক্ষা করতে থাকি। আমার বাবাটাকে একটু দেখব, একটু আদর করব, শেষবারের মতো একটু চুমু খাব। কিন্তু এমন হতভাগ্য মা আমি, আমার ছেলের লাশটাও দেখতে পারিনি। আমার জীবনটাই বৃথা।

বিউটি আক্তার বলেন, ‘রাব্বি অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমাকে রান্না, বাসন মাজা, ঘর মোছাসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতো। আমার শরীর খারাপ হলে আমাকে কোনো কাজ করতে দিত না। আমার কখন কী লাগবে, সব সে এনে দিত। এখন আমাকে আর কেউ জিজ্ঞাসা করে না, আম্মু তোমার কিছু লাগবে কিনা?।

ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে এমন ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে শহীদ রাব্বির বাবা ফারুক খান বলেন, ২০২৪ সালে এসে আন্দোলনে অংশ নিয়ে সারা দেশে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বৈরাচারমুক্ত দেশ পেয়েছি। আমি চাই ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যাতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে না পারে। আবার যেন হাজার হাজার মায়ের বুক খালি না হয়। যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।

নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। শুধু মুখে শহীদ বললে হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে।

একইসঙ্গে এই আন্দোলনে সারা দেশের যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন করার দাবি জানান শহীদ রাব্বির বাবা।

কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ফারুক খান বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ১০ এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন আকরাম খান রাব্বি। বিকাল ৪টার দিকে রাজপথে আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি। এ ঘটনায় গত ২৫ আগস্ট পল্লবী থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৮ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন বাবা ফারুক খান। এ মামলায় ইতোমধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close