মৃনাল সরকার মিলু, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৫

যত্রতত্র পুকুর খনন, অস্তিত্ব সংকটে সেচ প্রকল্প

সিরাজগঞ্জে গণহারে পুকুর খনন করায় আবাদি জমির অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে শতাধিক সেচ প্রকল্প। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব প্রকল্প থেকে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রায় ছয় হাজার হেক্টর কৃষি জমি পুকুর শ্রেণিতে পরিণত হওয়ায় ও পাঁচ হাজার হেক্টর জমি পুকুর খননে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে কৃষিজাত ফসল উৎপাদনে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

একাধিক দপ্তরের সূত্র জানায়, এ সংকট সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে জেলার চলন বিল এলাকার তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জে।

সূত্র জানায়, স্মরণাতীতকাল থেকে এ অঞ্চলের কৃষক ফসল ফলাতেন প্রাকৃতিক উৎস হতে প্রাপ্ত পানি ব্যবহার করে। গত শতাব্দীর ৮০ দশক থেকে নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এবং এক ফসলি জমি দুই ও তিন ফসলের আওতায় আনতে কৃষক নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ভূগর্ভস্থ পানির উপর। এসময় তারা ডিজেলচালিত শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে কৃষিতে বিপ্লব আনেন।

কিন্তু গণহারে ও অপরিকল্পিতভাবে মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় ৯০’র দশকে পানির স্তর দ্রুত নিচে নামতে থাকে। পাশিপাশি ডিজেলচালিত সেচব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ায় কৃষক খুব একটা লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায় সরকার বিপুল পরিমাণ কৃষি ও অকৃষি জমি চাষযোগ্য ও লাভজনক করার লক্ষ্যে সমবায়ভিত্তিক বিদ্যুৎচালিত সেচ প্রকল্প হাতে নেয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএডিসির আওতায় পানাসি প্রকল্প ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিরাজগঞ্জ জেলায় স্থাপন করে বিদ্যুৎচালিত মোট ৫৯৭টি গভীর নলকূপ। এছাড়াও বিদ্যুৎশক্তিচালিত পাম্প স্থাপন করা হয় ১ হাজার ৩১৮টি ও ব্যক্তিপর্যায়ে অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয় ৩ হাজার ১৭৮টি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, এতে করে এক লাখ ৮২ হাজার ১০০ হেক্টর জমি চাষের আওতায় এসেছে। শস্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদি ও উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন জাত মাঠে নিয়ে আসায় উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এক ফসলি অধিকাংশ জমি রূপান্তরিত হয় দুই ও তিন ফসলিতে। এসব জমি থেকে উৎপাদিত ফসল জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাইরে বিক্রি করা হয়।

কিন্তু গত এক দশকে জেলার তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ উপজেলায় গণহারে পুকুর খনন করায় কমে গেছে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় আরো প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর কৃষিজমি জলাবদ্ধতায় অনাবাদি হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে গভীর নলকূপের সেচ প্রকল্পগুলোর মাঝে পুকুর খনন করায় শতাধিক সেচ প্রকল্প অত্বিস্ত সংকটে পড়েছে। সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় এসব সেচ প্রকল্প থেকে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব, অপরদিকে উৎপাদনেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। এরই মধ্যে ২০টি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেসব প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে মর্মে পানাসি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

সরেজমিনে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, উল্লাপাড়া উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া মৌজায় পাশাপাশি রয়েছে বিএডিসি পানাসি প্রকল্পের তিনটি গভীর নলকূপ। এর মধ্যে স্থানীয় ভূমিগ্রাসীচক্র প্রায় ১০০ বিঘার একটি পুকুর খনন করে রীতিমতো মাছ চাষ করছে। পাশে আরেকটি দেড়শ বিঘার পুকুর খনন করার প্রস্তুতি চলছে। এ কাজে দুটি খনন যন্ত্র (এস্কেভেটর) আনা হয়েছে। এতে করে তিনটি গভীর নলকূপের প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে মর্মে অভিযোগ করেছেন একটি গভীর নলকূপের প্রকল্প ম্যানেজার খলিলুর রহমান। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে আবু বক্কর মেম্বার ও তার সহযোগীরা ক্ষমতার জোরে প্রকল্পের মাঝে ১০০ বিঘার পুকুর খনন করেছিল। এতে করে এ সেচ প্রকল্পটি এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

এখন আবার স্থানীয় বিএনপির নেতারা সংঘবদ্ধ হয়ে আরো ১৫০ বিঘা সেচ প্রকল্পের জমিতে পুকুর খনন করার চেষ্টা করছেন। নিরুপায় কৃষক তাদের কৃষিজমি রক্ষা করতে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না।

একই চিত্র দেখা গেছে তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া, মঙ্গলবাড়িয়া, সান্তান, বাঁশবাড়িয়া, কাউরাইল, মাধাইনগর, ঝুরঝুরি, তাড়াশ পৌর সদর মাঠে বিএডিসির পানাসি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পে।

বোয়ালিয়া গ্রামের সোলায়মান হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আমাদের মাঠে আর কোনো আবাদি জমি অবশিষ্ট নেই। যার ফলে এখানকার দুটি সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু পুকুর আর জলাবদ্ধতা। একই অভিযোগ করেন মাধবপুর গ্রামের কৃষক মনসুর আলী। এ প্রসঙ্গে বিএডিসির সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী চিত্তরঞ্জন রায় ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পুকুর খননে অনেক সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে আমরা অন্যত্র পুনঃস্থাপন করে আবারও প্রকল্পগুলো সচল করার চেষ্টা করছি। এতে করে সরকারের আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ. জা. মু. আহসান শহীদ সরকার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, গণহারে পুকুর খনন করায় কৃষিজমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উচ্চ ফলনশীল জাত মাঠে থাকায় এখনো লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা হলেও ঠিক রাখা যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় জনসচেতনতা। তা না হলে কৃষিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close