প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থানগাথা
পুত্রের কবর দেখার আশায় মা রাশেদা

পুত্রশোকে দিশাহারা মা রাশেদা বেগম তার প্রিয় সন্তানের কবর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তিনি জানেন না, পুত্রের কবর কবে খুঁজে পাবেন কিংবা আদৌ পাবেন কি না। সরকারের কাছে তার আবেদন, জীবদ্দশায় সন্তানের কবর যেন দেখে যেতে পারেন সে ব্যবস্থা করার। পোশাক ব্যবসায়ী মো. সোহেল রানা (৩৭) রাজপথে বিক্ষোভে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের পর থেকে পরিবারের সদস্যরা তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালান। দীর্ঘদিন ধরে খোঁজাখুঁজি করে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, সোহেল শাহাদাতবরণ করেছেন। কিন্তু তারা খুঁজে পাননি তার কবর।
নিখোঁজ হওয়ার এক মাস পর তারা জানতে পারেন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে আরো অনেকের সঙ্গে সোহেলকেও রায়েরবাজারে একটি অজ্ঞাত কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সোহেলের মা রাশেদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বাসসকে বলেন, ‘১৮ জুলাই সারা দিন আমার ছেলে আমার পাশেই শুয়ে ছিল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসা থেকে সে বের হয়ে যায়। তারপর থেকে আমি আমার ছেলেকে দেখতে পাইনি।’ শোকাহত মা শুধু দেখতে চান যে, তার প্রিয়পুত্র চিরনিদ্রায় কোথায় শুয়ে আছে। তিনি বলেন, ‘এতদিন হয়ে গেল, এখনো জানতে পারিনি আমার ছেলের কবর কোনটি। আমি আমার ছেলের কবর দেখতে চাওয়া ছাড়া আর কিছুই চাই না।’
সোহেলের পরিবারের সদস্যরা জানান, থানা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) থেকে প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে যোগ দেন সোহেল। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে ব্যাপক অভিযান শুরু হলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওইদিন যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় বিক্ষোভে যোগ দেন সোহেল। যাত্রাবাড়ীর কদমতলী এলাকার মোহাম্মদবাগের বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তিনি তার ফেসবুক ও টিকটক অ্যাকাউন্টে কয়েকটি ভিডিও পোস্ট করেন। এ ভিডিওগুলোতে আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সরকারি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো হয়।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সোহেল ছিলেন সবার বড়। তার একমাত্র বোন লাভলী আক্তার (৩২) বিবাহিত। তার ছোট ভাই মো. জুয়েল (২৯) একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং মো. রুবেল (২৪) ও মো. নাবিল (১৯) বেকার। তার বাবা মো. লাল মিয়া (৬৫) অসুস্থতার কারণে এখন কাজ করতে পারছেন না। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা থেকে এসে দীর্ঘদিন ধরে মোহাম্মদবাগ এলাকায় বসবাস করছে এ পরিবার। ভাইকে খোঁজাখুঁজির সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে নাবিল বলেন, যে রাতে সোহেল নিখোঁজ হয়, সে রাত ১০টার দিকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পান। তিনি দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে না পারায় আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি এবং তাকে আটকে রাখা হয়েছে ভেবে আশপাশে খুঁজতে শুরু করি। আমরা থানায়ও গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে, আমার ভাইকে হত্যা করা হতে পারে!’
নাবিল অবশ্য জানান, তিন দিন পর তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও ন্যাশনাল বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে লাশের মধ্যে তার ভাইকে খোঁজেন। তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের মর্গে গিয়ে সারি সারি লাশের মধ্যে আমার ভাইকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। ভাইয়ের খোঁজ করে আমাদের মনের কষ্টই কেবল বেড়েছে। অনেক লাশ সেখানে পড়েছিল, কিন্তু আমার ভাই তাদের মধ্যে ছিল না।’
একজনের পরামর্শে পরে তারা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যারা দাবিহীন লাশ দাফন করে। কিন্তু তাদের রেকর্ডেও সোহেলের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নাবিল বলেন, ‘সেসময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। পরে ইন্টারনেট চালু হলে আমরা সোহেলের নিখোঁজ হওয়ার খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার করেছি। কিন্তু কোনো জবাব পাইনি। এতে আমার ভাইকে পাওয়ার আশা আরো ক্ষীণ হয়ে যায়।’
নাবিল তার ভাইকে খোঁজাখুঁজি করার কষ্টকর স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ২৮ বা ২৯ জুলাই ‘স্বৈরাচারমুক্ত দেশ চাই’ নামে ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও দেখে আমরা চমকে যাই। এতে দেখা যায়, আমার ভাইয়ের নিষ্প্রাণ দেহ রাস্তায় পড়ে আছে। তার পাশে একটি শিশুর লাশ পড়ে আছে। তবে আমরা ওই পেজের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।’
নাবিল বলেন, ‘আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ার ৩৪ দিন পর ২১ আগস্ট আমরা আমার ভাইকে খুঁজে পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু পাই। সেদিন কদমতলী থেকে একজন অপরিচিত ব্যক্তি আমার ভাই জুয়েলকে ফোন করে জানান যে, তিনি অনলাইনে সোহেলের নিখোঁজ হওয়ার খবরটি দেখেছেন।’ অপরিচিত ঐ ব্যক্তি আরো জানান, জুলাই বিপ্লবে নিখোঁজ তার নিজের ভাইকে খুঁজতে গিয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ‘অজ্ঞাতনামা (২৮), জিডি-১৩৫৯’ লেবেলযুক্ত একটি অজ্ঞাত লাশের ছবি দেখেছেন যার সঙ্গে আমার ভাইয়ের ছবির মিল রয়েছে।
স্মৃতি ভারাক্রান্ত নাবিল বলেন, ‘অপরিচিত ঐ ব্যক্তির ফোন পেয়ে আমার ভাই জুয়েল অবিলম্বে ঢামেক হাসপাতালে যান, সেখানে তিনি ছবিটি দেখতে পান এবং জানতে পারেন যে আঞ্জুমানে মফিদুল সোহেলকে একজন বেওয়ারিশ ব্যক্তি হিসেবে দাফন করেছে।’
পরের দিন তারা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের দাফনসেবা কর্মকর্তা কামরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে, সোহেলকে ২৪ জুলাই রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
দুঃখভারাক্রান্ত নাবিল বলেন, ‘আমার ভাই একই অফিসারের সঙ্গে আগেও দেখা করেছিল, কিন্তু সেদিন তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ২৩ জুলাই শাহবাগ থানাপুলিশ তাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, তিনি আমার ভাইয়ের কবর সম্পর্কে সঠিক তথ্য নিশ্চিত করতে পারেননি।
তিনি আরো বলেন, ‘কবরের রেজিস্ট্রি নেই, শুধু একটি অস্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, আমার ভাইকে অন্যান্য অজ্ঞাত লাশের সঙ্গে কবর দেওয়া হয়েছে’। যখন তারা তার ভাইয়ের কবে, কখন, কোথায় এবং কীভাবে মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক তথ্য বের করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সেসময় তারা শাহবাগ থানায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। ওই কর্মকর্তা তাদের ভাইয়ের মৃত্যুর ভয়ানক খবরটি দেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর আগে সোহেলকে গুলি এবং শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়। ১৮ জুলাই রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকার কয়েকজন শিক্ষার্থী রাবার বুলেটবিদ্ধ তার লাশ ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যায়। ২৩ জুলাই পর্যন্ত লাশটি হাসপাতালের মর্গে ছিল। ২৩ জুলাই সোহেলের লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করা হয়।
সেসময় সোহেলের পরিবার হাসপাতাল থেকে একটি নামহীন মৃত্যু সনদপত্র পায় যা তাদের দুঃখকে আরো গভীর করে তোলে। নাবিল বলেন, ‘কেন আমার ভাইয়ের মরদেহকে ‘বেওয়ারিশ’ লেবেল দেওয়া হয়েছিল যখন একটি পরিবার তাকে খুঁজে পেতে মরিয়া ছিল? কেন আমাদের আগে জানানো হয়নি? কেন আমরা তাকে যথাযথভাবে দাফন করতে পারলাম না? এসব হৃদয় নিংড়ানো প্রশ্ন আজও আমাদের পরিবারের প্রত্যেককে সারাক্ষণ তাড়া করে।
এমনকি তার ভাইয়ের সঠিক পরিচয় দিয়ে মৃত্যু সনদ পেতেও তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন উল্লেখ করে নাবিল বলেন, ‘অবশেষে আমরা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের সহায়তায় মৃত্যু সনদটি পেয়েছি’। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তৎকালীন ‘ফ্যাসিবাদী সরকার’ ১৮ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। সেদিন, অনেক লোক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের হামলায় নিহত হয়েছিল বলে জানা গেছে। গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের চিকিৎসা না দিতে সরকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছিল এবং অনেক মৃতদেহ গায়েব করারও অভিযোগ রয়েছে।
সোহেলের কবর শনাক্ত করতে তাদের মরিয়া প্রচেষ্টার বর্ণনা দিয়ে নাবিল বলেন, ‘আমার ভাইয়ের কবর না জানার কষ্ট অসহ্য। আমরা এখনো এখানে-সেখানে দৌড়াচ্ছি অন্তত কবরটি শনাক্ত করার আশায় যেখানে আমার ভাই ঘুমিয়ে আছে। কারণ আমরা এখনো বিভ্রান্ত, আমার ভাইকে আদৌ কবর দেওয়া হয়েছিল কি না!’ তিনি বলেন, ‘আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ার রাতে যদি আমরা ঢামেক হাসপাতালে যেতাম, তাহলে কি আমার ভাইকে জীবিত পাওয়া যেত? আমরা কি তার লাশ দাবি করতে পারতাম এবং মর্যাদাপূর্ণ দাফন নিশ্চিত করতে পারতাম? এ বেদনাদায়ক প্রশ্নগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত গ্রাস করেছে আর আমরা এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে আবদ্ধ হয়ে আছি।’
নাবিল বলেন, ‘আমি যখনই চোখ বন্ধ করি তখনই আমি আমার ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। সে যেন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা কেন জানলে না আমার সঙ্গে কী হয়েছে?’ তার কথা স্মরণ করে আমি সারা রাত ঘুমাতে পারি না। এমনকি ঘুমের ওষুধ খেয়েও আমি ঘুমাতে পারি না।’
তিনি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের পরিবার আমার ভাইয়ের কবরের অবস্থান সম্পর্কে জানার আশায় আছে। আমরা আমার ভাইয়ের কবর শনাক্ত করতে আমাদের সাহায্য করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও সরকার এখনো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’
নাবিল ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, ‘আমার ভাই শুধু একটি সংখ্যা ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন পুত্র, একজন ভাই, আমাদের জীবনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকার তাকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে। আমার ভাইকে শেষ দেখার এবং তাকে মর্যাদাপূর্ণভাবে দাফন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।’ অন্তত সোহেলের কবরের সঠিক অবস্থান জানতে মরিয়া ইচ্ছা প্রকাশ করে তার পরিবারের সদস্যরা জানান, এতে তাদের কষ্ট কিছুটা কমবে। নাবিল প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের ভাইকে কোথায় দাফন করা হয়েছে?’ এটি জানতে চাওয়া কি খুব বেশি চাওয়া? এটা জানা কি আমাদের অধিকার নয়?
সোহেলের পরিবার সোহেলসহ আরো অগণিত হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষীদের গ্রেপ্তার ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। সোহেলের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। মোহাম্মদবাগের আবাসিক এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সোহেলের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, সোহেল একজন ভালোমনের মানুষ ছিলেন। তিনি যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কারো বিপদ দেখলে সাহায্য করতেন। এদিকে আবাসিক এলাকার রাস্তায় সোহেলের কবর শনাক্তের আবেদন সংবলিত একটি ব্যানার ঝুলতে দেখা গেছে। সোহেলের প্রতিবেশীরা এ ব্যানার টাঙিয়ে রেখেছেন।
"