প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থানগাথা
আহতদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন দাবি আইমানের

একটা স্বাধীন দেশের সরকার কেন জনগণের ওপর গুলি চালাবে? ভবিষ্যতে আর কোনো সরকার যেন রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে দেশের জনগণের ওপর এমন বর্বরতা না চালাতে পারে, সে জন্য বাহিনীগুলোকে জবাবদিহিতা এবং কঠোর নিয়মনীতির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি না চালিয়ে বরং দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দেবে আমি এমন একটা রাষ্ট্র চাই। রাজধানীর ধানমন্ডির ১নং রোড়ের বাসায় আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত আইমান উদ্দিন এসব কথা বলেন। খবর বাসস।
আহতদের চিকিৎসার ব্যয় সরকারকে বহন করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে যারা আহত তাদের অনেকেই এখনো ভালো ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন না। তাদের যেন প্রপার ট্রিটমেন্টের আওতায় আনা হয়। একইসঙ্গে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও যেন নজর দেওয়া হয়। জুলাই আন্দোলনে বিভিন্ন বাহিনীগুলোর নিষ্ঠুর ভূমিকার জন্য আহত ও শহীদ পরিবার এবং জনগণের কাছে বিগত সরকার যেন ক্ষমা চায়। আহতদের চিকিৎসার ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে। এত দিনেও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তেমন কিছু করা হয়নি, যা হতাশাজনক।’
আহত আইমান বলেন, ‘১৯ জুলাই আমার বুকে গুলি লাগে। আমি ১৫ দিনের বেশি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরে ৫ আগস্ট হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরি। এখন আমি অনেকটা সুস্থ হলেও, আমার বুকে মাঝে মাঝে ব্যথা করে। বেশি সময় হাঁটতে পারি না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হয়।
অনেক সময় সব কিছু ভুলে যাই। আমার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। আমার পরিবার আমার জন্য ২২ লাখ টাকার বেশি খরচ করেছে। এখন সরকার যদি আমাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করত তাহলে ভালো হত।’ আইমান উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মনপুরা গ্রামে। বাবা হেলাল উদ্দিন স্পেন প্রবাসী। মা রেহানা আক্তার গৃহিণী। আইমানরা তিন ভাই। তিনি সবার বড়। আইমান এইচএসসি পাস করেছেন গত বছর। এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে আহত হওয়ার পর পড়েছে লেখাপড়ায় ভাটা। তার মেজ ভাই সায়মন উদ্দিন নবম এবং ছোট ভাই নাইম উদ্দিন ধানমন্ডির একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। দাদি সালেহা বেগম বেঁচে থাকলেও দাদা ইউসূফ আলী ২০০৩ সালে মারা গেছেন।
আইমান বলেন, সেদিন ছিল ১৯ জুলাই শুক্রবার। সকাল থেকেই রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়, ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাব, সিটি কলেজ মোড়সহ আশপাশের এলাকায় চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং গোলাগুলি। পুলিশের ছোড়া টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আশপাশের এলাকা ছিল অন্ধকার। এমনকি সায়েন্স ল্যাব মোড়ের আশপাশের বাসাগুলোতেও টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকেই। সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে একটানা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গোলাগুলি।
তিনি বলেন, ঘটনার দিন ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার পরে পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়। তখন আশপাশের বাসার ছাদে অনেকেই অবস্থান করছেন। ছাদ থেকে বাইরের পরিস্থিতির ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন অনেকেই।
আইমান উদ্দিন বলেন, আশপাশের বাসার সবাইকে ছাদে যেতে দেখে আমার ফুপি নাছিমা আক্তার আমাদের দুই ভাইকে (আমি ও মেজ) সঙ্গে নিয়ে ছাদে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই ছাদে যাওয়াই আমাদের জন্য কাল হলো। ছাদে গিয়ে আমরা যখন দাঁড়াই এর কিছু সময় পরেই হেলিকপ্টার থেকে করা একটা গুলি এসে আমার বুকের এক পাশে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে ফুপির গাল দিয়ে ঢুকে খাদ্যনালিতে আটকে যায়। গুলিবিদ্ধ হয়েই ফুপি ছাদে পড়ে যান। ২০ জুলাই বিকেলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফুপি নাছিমা আক্তার। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে ফুপি নোয়াখালী থেকে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। পরে ২১ জুলাই সকাল ৮টার দিকে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মনপুরা গ্রামে তাকে দাফন করা হয়।
আইমান উদ্দিনের মা রেহানা আক্তার ওই দিনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, আমার ননদ নাছিমা আমার দুই ছেলেকে নিয়ে বিকেল ৫টার দিকে ছাদে যায়। ওই সময় হেলিকপ্টার আমাদের এলাকায় চক্কর দিতে থাকে। সাড়ে ৫টার দিকে একটা গুলি আমার ছেলের বুকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে পেছনে থাকা নাছিমার গালের ভেতর দিয়ে খাদ্যনালিতে আটকে যায়। আমাদের ধারণা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। কারণ সে সময়ে আশপাশের পরিবেশ শান্ত ছিল।
তিনি বলেন, আমি ওদের নিষেধ করেছিলাম ছাদে যাওয়ার দরকার নেই। তখন নাছিমা বলে, অনেক সময় হলো বাসায় বন্দি, ভালো লাগছে না। আমি ওদের নিয়ে ছাদে যাই। তখন আশপাশের বাসার অনেকেই ছাদে অবস্থান করছিলেন দেখে, আমিও আর কিছু বলি নাই।
রেহানা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটার বুকে গুলি লাগলেও আল্লাহ নিজ হাতে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ননদটা মারা গেছে। আইমান মোটামুটি সুস্থ হলেও, সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কোনো কিছু মনে করতে পারে না।
মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা করে ওর। কোনো কিছুর শব্দ শুনলেই ভয়ে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে। সবসময় বসে বসে কি যেন ভাবতে থাকে। ওর উন্নত চিকিৎসা দরকার। উন্নত চিকিৎসার বিষয়টা যদি সরকার দেখত তাহলে ভালো হত। আমি ছেলের চিকিৎসার জন্য ২২ লাখ টাকার বেশি খরচ করেছি।
সেদিনের ছাদের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আইমান আরো বলেন, আমরা যখন ছাদে যাই তখন মাথার ওপর হেলিকপ্টার উড়ছিল। আমার ধারণা হেলিকপ্টার থেকে করা গুলি আমার ও ফুপির গায়ে লাগে। তখন আমার ছোট ভাই আমাকে ধরে লিফটে করে নিচে নামায়। পরে আমার আর কিছু মনে নেই। মা রেহানা আরো বলেন, ‘ঘটনা শুনে আমি চিৎকার শুরু করি। আশপাশের বাসার মানুষ এসে আমার ছেলে ও ননদকে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যায়। সে সময় যে কি একটা অবস্থা ছিল, ইন্টারনেট ছিল না। কোথাও কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না। ওদের হাসাপাতালে নিতেও বাধা দেওয়া হয়েছিল। পরে আমার ছেলের চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করে আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু ননদকে বাঁচাতে পারেননি। নাছিমা ২০ তারিখ বিকেলে মারা যায়। আইমান ১৫ দিন চিকিৎসার পর ৫ আগস্ট বাসায় ফিরে।’
আইমানের মা রেহানা আক্তার বলেন, ‘শুনেছি যে সব ফ্যামিলি থেকে শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে তাদের সরকার অনেক ধরনের সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমরাতো কিছু পাইলাম না। আমার ছেলের চিকিৎসা করাতে ২২ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। ননদ তো মারাই গেছে। কিন্তু কেউ কোনো আর্থিক সহযোগিতা দেয় নাই। নিজেরা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আমার ননদকে নোয়াখালী নিয়ে দাফন করেছি। এখন আইমানকে নিয়ে পড়েছি বিপদে। ও শতভাগ সুস্থ কবে হবে, কে জানে?
"