নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

দুশ্চিন্তায় নিম্নআয়ের মানুষ

নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি চালু করে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। ফলে টিসিবির পরিবার কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। গত অক্টোবর মাসে চালু করা এই কর্মসূচি মাত্র দুই মাস সাত দিন চলার পর বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। অন্যদিকে গত অক্টোবরে ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এটিও সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

রাজধানীর মানিকনগর বড়পুকুর এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন রিকশাচালক বুরহান উদ্দিন। তিনি শ্বাসকষ্টের রোগী, তাই প্রতিদিন রিকশা চালাতে পারেন না। যেদিন রিকশা চালান, সেদিন তার দৈনিক আয় পাঁচশ থেকে ছয়শ টাকা। আর যেদিন অসুস্থতার কারণে রিকশা চালাতে পারেন না, সেদিন কোনো আয় নেই তার। স্ত্রী কুহিনূর গৃহকর্মীর কাজ করেন দুই বাসায়। সেখানে তার মাসিক আয় ৬ হাজার টাকা। দুই ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে। বাসাভাড়া, দুই সন্তানের স্কুলের বেতন, বই-খাতা-কলম কেনা, খাবার খরচসহ তার মাসিক খরচ ১৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে টানাটানির সংসার। এক্ষেত্রে এতদিন সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বাজারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির ট্রাক থেকে পাওয়া তেল, ডাল ও চাল। ৩১ ডিসেম্বরের পর সরকারের এই কর্মসূচি বন্ধ। আবার চালু হবে কিনা তাও নিশ্চিত নন কেউ। তাই অনেকটাই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বুরহান উদ্দিন।

বুরহান উদ্দিনের মতো রাজধানীর হাতিরঝিলের কুনিাপাড়ার বাসিন্দা কমলা বেগম, মাদারকেটের হালিমা আক্তার ও গোপীবাগের বাসন্তীরও মাথায় হাত। এরা সবাই খেটেখাওয়া নিম্নআয়ের মানুষ। টিসিবির ট্রাক থেকে পাওয়া প্রতি মাসে চাল, তেল ও ডাল তাদের চিন্তামুক্ত থাকতে সহায়ক ছিল। গোপীবাগের বাসন্তী বলেন, ‘ঘরে ভাত-ডালের নিশ্চয়তা থাকলে কাজে মন বসে, মাথাটা ভালো কাজ করে’। কিন্তু এখন তাদের চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কপালে। কারণ টিসিবি খোলা ট্রাকের মাধ্যম এসব পণ্য বিক্রির কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে চাল, তেল ও ডাল কেনা অনেকটাই কষ্টসাধ্য বলে মনে করেন তারা।

কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর গত অক্টোবর মাসে ট্রাকে করে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল টিসিবি। ফলে পরিবার কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাড়ে ২৪ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন। মাত্র দুই মাস সাত দিন চলার পর এ কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থাটি। তবে সারা দেশে এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য দিতে আগের সরকারের নেওয়া কর্মসূচিটি চালু থাকবে বলেও জানিয়েছে টিসিবি কর্তৃপক্ষ।

সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য টিসিবির ট্রাকে করে ভর্তুকি দেওয়া পণ্য বিক্রির নির্ধারিত শিডিউল শেষ হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতির এই বাজারে বাড়তি আর্থিক চাপ সামলাতে না পেরে অনেক সুবিধাভোগী আবারও টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি চালুর দাবি জানিয়েছেন। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আপাতত এ কর্মসূচি চালুর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা নেই। শুরুতে এ কার্যক্রম ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে হিসেবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলেছে, জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে গেছে টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম।

উল্লেখ্য, গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগরীতে ৫০টি ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২০টি ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে অর্থাৎ ১০০ টাকা লিটার দরে তেল, ৬০ টাকা কেজি দরে মসুর ডাল ও ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল টিসিবি। এ কার্যক্রমের আওতায়, একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ ২ লিটার ভোজ্যতেল ২০০ টাকায়, ২ কেজি মসুর ডাল ১২০ টাকায় এবং ৫ কেজি চাল ১৫০ টাকায় কিনতে পারতেন। বর্তমানে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা ও প্রতি কেজি চাল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে শুধু স্মার্ট কার্ডধারী পরিবারকেই পণ্য দেবে টিসিবি। এক্ষেত্রে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের মধ্যে শুধু ৫৭ লাখ স্মার্ট কার্ডধারী এ সুবিধা পাবেন। বাকি ৪৩ লাখ পরিবারের কাছে স্মার্ট কার্ড না থাকায় তারা সরকারের এই সুবিধা আপাতত পাবেন না। টিসিবির পণ্য কেনার জন্য একটি পরিবারকে এতদিন একটি সাধারণ কাগুজে কার্ড দেওয়া হতো। পুরোনো এই কার্ড বাতিল করে এখন স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে পণ্য বিতরণ শুরু করেছে টিসিবি।

টিসিবির চেয়ারম্যানের মুখপাত্র হুমায়ুন কবির জানান, ট্রাক সেল কার্যক্রম কিন্তু সারা বছর চালানো হয় না। যখন মূল্যস্ফীতি বেশি থাকে বা কোনো পণ্যের বিশেষ চাহিদা থাকে, তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় টিসিবি ট্রাক সেল কার্যক্রম পরিচালনা করে। তার অংশ হিসেবে অক্টোবরে ২৮ হাজার পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নভেম্বর পর্যন্ত এটা চলমান থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

তাহলে বন্ধের কারণ কী, মূল্যস্ফীতি কি কমে গেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি টিসিবি জানে না। জানে মন্ত্রণালয়, অর্থাৎ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। টিসিবি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। টিসিবি সংক্রান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত টিসিবি কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করে। তিনি আরো জানান, প্রয়োজন অনুসারে ট্রাক সেল পরিচালনা করা হয়। বাজারে চাহিদা বেশি থাকলে, তখন টিসিবি ট্রাক সেল পরিচালনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। যেমন রমজানে ছোলা ও খেজুর বিক্রি করা হয়। গত নভেম্বরে আলুর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে আলু বিক্রি করেছিল টিসিবি।

জানা গেছে, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের সংশোধন নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হচ্ছে না। এর ফলে ৪৩ লাখ কার্ডধারী পরিবার কবে নাগাদ স্বল্পমূল্যে টিসিবির পণ্য পাবেন, তা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। অথচ বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে এই টিসিবির পণ্যই হতে পারে গরিব পরিবারের জন্য বড় সহায়ক- এমনটাই মনে করেন কার্ডধারীরা। অন্যদিকে সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই, মার্চের শুরুতে রমজান শুরুর আগেই দেশের পুরো ১ কোটি পরিবার টিসিবির পণ্য হাতে পাবেন।

জানা গেছে, এক পরিবার এক কার্ড- এই নিয়মেই হওয়ার কথা ছিল টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড। অথচ দীর্ঘসময় রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার এই কার্ডকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতারা কখনো তাদের দলীয় কর্মীদের পরিবারকে, আবার কখনো সুবিধা গ্রহণের মধ্য দিয়ে অন্য সব পরিবারে দিয়েছে একাধিক কার্ড। যে পরিবারে বাবার নামে কার্ড আছে, সেই একই পরিবারে মায়ের নামেও কার্ড আছে। আছে ওই পরিবারের ছেলের নামেও টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এতদিন এভাবেই চলছিল, অথচ এটি হওয়ার কথা নয়। এ কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার পরিমাণ ৪৩ লাখেরও বেশি। যাচাই-বাছাই শেষ করে গত ১৫ নভেম্বরের মধ্যে একটি ফ্রেশ তালিকা তৈরি করে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে টিসিবিতে পাঠানোর জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার কাঠামো সচল না থাকায় কাজটি জটিল হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার শুভপুরের কুলসুম আক্তার বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই টিসিবির পণ্য পাচ্ছি না। আমার কার্ডে নাকি ঝামেলা আছে। পুরান কার্ড নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলাম। তারা বলেছে এখন নতুন কার্ড হবে। তখনই টিসিবির পণ্য পাব।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। একটি পরিবারে একটি কার্ড থাকার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে একাধিক কার্ড। এ ছাড়া আরো অনিয়ম রয়েছে। যারা এই কার্ড পাওয়ার যোগ্য নন, তাদেরও দেওয়া হয়েছে টিসিবির কার্ড। এর মধ্য দিয়ে অনেকে দরিদ্র পরিবার সরকারের দেওয়া এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সবগুলো অনিয়ম দূর করে একটি সুন্দর নিরপেক্ষ তালিকা করার জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কাজ করছে। এ কাজের সঙ্গে এডিসি, ইউএনও, জনপ্রতিনিধি ও ছাত্র সমন্বয়কদেরও যুক্ত করা হয়েছে। কাজটি কঠিন বলেই সময় লাগছে।

এদিকে দ্রুত কাজটি করার জন্য টিসিবির স্মার্ট কার্ড তৈরির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সহায়তা চেয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। সম্প্রতি এই সহায়তা চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে লিখিত চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি।

চিঠিতে তিনি দ্রুত স্মার্ট কার্ড প্রণয়নের স্বার্থে উপকারভোগী বাছাই নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণে প্রকৃত প্রাপ্য পরিবার নির্বাচন করে অবশিষ্ট প্রায় ৪৩ লাখসহ যারা দীর্ঘদিন পণ্য গ্রহণ করেন না বা কার্ডধারী পরিবার এই সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত নয়, তাদের স্থলে নতুন উপকারভোগী অন্তর্ভুক্ত করে ডাটাবেজ প্রস্তুত করে টিসিবিতে পাঠানোর জন্য ডিসিদের অনুরোধ জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, পুরো এক কোটি পরিবারকেই স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য দেবে সরকার। আপাতত ট্রাক সেল কার্যক্রম পরিচালনার কোনো পরিকল্পনা নাই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close