নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫

গণঅভ্যুত্থানগাথা

‘ফিরে আসবে না, তবু ছেলের অপেক্ষায় থাকি’

রিফাত আমার সবচেয়ে ছোট ছেলে ছিল। এখন সবাই আছে কিন্তু সবার ছোট রিফাতকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি জানি, সে কখনোই আমার কাছে ফিরে আসবে না। তবুও আমি ছেলের অপেক্ষায় থাকি।

কথাগুলো বলেন, গত ৫ আগস্ট শহীদ আবু বকর রিফাতের মা বিউটি আক্তার। বিউটি আক্তার সন্তান হারানোর বেদনায় বিমূঢ় হয়ে আছেন। গণঅভ্যুত্থানে প্রিয় পুত্র রিফাতকে (২৩) হারিয়ে গভীর শোকে নিমজ্জিত তিনি। যে ছেলে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মাকে চুমু খেতেন সে আজ আর নেই। তাই তিনি ডুকরে কাঁদেন রোজ।

রিফাত গত ৫ আগস্ট শহীদ হন। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সেদিন শেখ হাসিনার পতন ঘটে। সে আনন্দে নগরীর অন্য এলাকার মতো যাত্রাবাড়ীতেও হাজারো মানুষের ঢল নামে। এদের সঙ্গে রাস্তায় আনন্দ মিছিলে যোগ দেন মোহাম্মদবাগ আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র রিফাত। এই স্কুলে ভর্তির আগে রিফাত কওমি মাদরাসায় মিজান পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। কওমি মাদরাসায় ভর্তির আগে তিনি অন্য একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন।

রিফাতের মৃত্যুতে তার মা বিউটি আক্তারের শোক কিছুতেই কাটছে না। তিনি দেশের সার্বিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমার ছেলে সবার জন্য স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে তার জীবন উৎসর্গ করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা কোথায়? আমরা এখনো গণপরিবহন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারিনি।’

গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ পুত্রের সম্পর্কে আলাপকালে বিউটি আক্তার বলেন, আমার ছেলের জীবনের বিনিময়ে আমি সারা দেশে শান্তি দেখতে চাই। যার মাধ্যমে দেশে সব ধরনের ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ হবে। দরিদ্র ও দুস্থদের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে।

শহীদ সন্তানের গর্বিত বাবা মো. আওলাদ হোসেন বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দান করায় আমার কোনো দুঃখ নেই। আওয়ামী লীগের পতনের পর হাজার হাজার মানুষকে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখে আমি তখনই আমার চোখের পানি মুছে ফেলেছি। তিনি বলেন, ‘এটা গর্বের বিষয় যে আমার ছেলে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছে।’ চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় রিফাত সবসময় ন্যায়বিচারের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এমনকি যখন তার মা তাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদানের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন তখনো তিনি তার অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াননি। রিফাতকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিলে তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতেন, ‘আমাকে হত্যা করা হলে আমি শহীদ হব। যদি কেউ শহীদ হয় তার কোনো পাপ থাকে না।’ রিফাত এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাটি বলতেন, যা বিউটিকে একইসঙ্গে ভীত এবং অনুপ্রাণিত করেছিল।

রিফাতের বড় ভাই মাহবুব রানা এবং দ্বিতীয় ভাই সাইম আহমেদ সৌদি আরব প্রবাসী। তার ছোট বোন সামিয়া আক্তার কওমি মাদরাসার ছাত্রী। রিফাতের পরিবার নগরীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকার মোহাম্মদবাগ থাকে। তার পিতা বর্তমানে তার দুই ছেলের প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

রিফাত প্রথম থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন উল্লেখ করে তার বাবা আওলাদ হোসেন ছেলের রাবার বুলেটের ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফেরার ঘটনাটি স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না তার ছোট বোন এটি আবিষ্কার করেছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সে আমাদের কাছ থেকে এটি লুকিয়ে রেখেছিল। আমরা যাতে কোনোভাবেই উদ্বিগ্ন না হই।’ রিফাতের মৃত্যুর দিনের স্মৃতি স্মরণ করে আওলাদ বলেন, সেদিন রিফাত সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে রায়েরবাগের প্রধান সড়কে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়। তিনি বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার আগে রিফাত পরোটা দিয়ে নাস্তা করে মায়ের আদর নিতে যায়। মায়ের কপালে ও গালে চুমু খায়।

আওলাদ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলেন, ‘আমি আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হলে রিফাতের কয়েকজন বন্ধু কাছে এসে আমাকে তাদের সঙ্গে রায়েরবাগে যেতে বলে। আমি যখন রায়েরবাগ পৌঁছালাম, তারা আমাকে বলল যে রিফাত মাতুয়াইল হাসপাতালে আছে। তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমার ছেলে আর নেই!’ তিনি শোকার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘কিন্তু রিফাতকে আমরা সেখানে পাইনি। পরে, আমরা মাতুয়াইল হাসপাতালের পাশে একটি বেসরকারি হাসপাতালে রিফাতের মরদেহ পেয়েছি’।

রিফাতের শোকাহত বাবা জানান, পরে তিনি জানতে পারেন যে সরকারের পতনের আনন্দে উল্লাস প্রকাশকারী হাজারো মানুষের সঙ্গে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পৌঁছালে তার ছেলে পুলিশ সদস্যদের গুলিতে প্রাণ হারায়। প্রিয় পুত্রকে শেষ বিদায় জানানোর হৃদয়বিদারক কাহিনী বর্ণনা করে অশ্রুসিক্ত চোখে আওলাদ বলেন, তারা ওইদিনই কদমতলী পারিবারিক কবরস্থানে রিফাতকে দাফন করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close