কামরুজ্জামান, লামা (বান্দরবান)
লামায় সরই ইউনিয়নে চলছে নৈরাজ্য, প্রশাসন নীরব
ফেয়ারি এগ্রোর বাগানে ২০০ একর জমির মূল্যবান গাছ কেটে নিয়ে গেছে লুটপাটকারীরা * লুটে নিয়েছে মাছ, গরু খামারের ঘরের বেড়া ও চালের টিন খুলে নিয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা
বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় সরই ইউনিয়নে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে চরম শঙ্কায় সময় পার করছেন উদ্যোক্তারা। একটি চিহ্নিত গ্রুপ প্রকাশ্যে দিবালোকে সন্ত্রাসী কায়দায় ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ফেয়ারি এগ্রোর গরু, ছাগল, খামারের মাছ এবং বাগানের গাছসহ ৫ কোটি টাকার অধিক মূল্যের সম্পদ লুটপাট করে নিয়েছে। শত একর বাগানের মূল্যবান গাছ কর্তন করে পাচার করায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও ফল পাচ্ছেন না বাগান মালিক। যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা পেতে ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয় জনসাধারণের পক্ষ থেকে একাধিক্রমে অভিযোগ-অনুযোগ করে ব্যর্থ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী মহলের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে উল্টো বাগান মালিক কর্মচারীসহ প্রতিবাদকারীদের চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। ফেয়ারি এগ্রোর বাগানটিতে স্থানীয় বেকার ও দরিদ্রপীড়িত শত মানুষ শ্রম দিয়ে সংসার চালাচ্ছে। ফজিয়া ইসলাম নামের একজন নারী উদ্যোক্তা সেখানে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে ও কায়িক পরিশ্রমে ধীরে ধীরে বাগান সৃজন, মৎস্য চাষ, এগ্রো বেইজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। বাগানটিতে শতাধিক কর্মচারী কর্মরত আছেন। এ বাগানে লুটেরাদের আক্রমণ থামাতে স্থানীয় কাম্যমাত্রায় প্রশাসনিক সহায়তা মিলছে না।
স্থানীয় জনসাধারণ এ কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপকারভোগী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে। বিগত জুলাই-আগস্ট ছাত্রজনতার বিপ্লবের পর একটি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ফেয়ারি এগ্রোর বাগানে লুটপাট চালায়। চিহ্নিত এসব লুটপাটকারীরা খামারের ২শটি উন্নত জাতের গরু, যেগুলোর আনুমানিক মূল্য দেড় কোটি টাকা, মৎস্য বাঁধ কেটে মাছ, যার আনুমানিক মূল্য ৫০ লাখ টাকা, কয়েকশ ছাগল, যার আনুমানিক মূল্য ১০ লাখ টাকা, হাঁস, মুরগি, যার আনুমানিক মূল্য ৫ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। লুটপাটকারীরা এ এগ্রোর বাগানে প্রায় ২শ একর জায়গার মূল্যবান গাছ কর্তন করে নিয়ে গেছে। তারা কেন এ নৈরাজ্য চালাচ্ছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যাচ্ছে না। প্রতিদিন বহিরাগত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দিয়ে গাছ কেটে গাড়িযোগে সড়ক পথে দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করছে। বর্তমানেও গাছ কর্তন করে পাচার অব্যাহত রেখেছে। এদিকে লুটপাটকারীরা ফেয়ারি এগ্রোর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী ও অন্যান্য কর্মচারীকে বাগান এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে বাগানের কর্মচারীরা চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব লুটপাটকারীরা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করার জন্য এ লুটপাট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে মর্মে বাগান শ্রমিক ও পক্ষ মনে করেন। লুটপাটকারীরা নিজে ও পাহাড়ে উগ্রসন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় ফেয়ারি এগ্রোর জায়গার উপর জোরপূর্বক অর্ধশত ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করে ভূমি জবরদখলের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর এসব ঘর দখল-বেদখল নিয়ে আরেকটি পাহাড়ি বাঙালি নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ফেয়ারি এগ্রোর বাগান লুটপাটের বিষয়ে লামা থানাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে বারবার অভিযোগ দায়ের এবং যোগাযোগ করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। বাগানের ম্যানেজার আবদুল কাদের জানান, অজ্ঞাত কারণে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের ফেয়ারি এগ্রোর বাগানে লুটপাটের বিষয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যার কারণে অপরাধীচক্র দ্বিগুণ উৎসাহে প্রতিদিন ফেয়ারি এগ্রোর জায়গায় বিদ্যমান অবশিষ্ট গাছ কর্তন করে পাচারে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে।
প্রতিদিন এবং রাতে ট্রাকযোগে বাগানের গাছ লুটপাটকারীরা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। বাগান মালিক ও কর্মচারীরা অসহায়ের মতো বাগানের গাছ কাটা ও লুটপাটের দৃশ্য দেখছে। বাগানে কর্মরত কয়েকজন কর্মচারী জানান, এ নৈরাজ্যকর লুটপাটকারীরা হচ্ছে- পাইসাশ্রু, শেখ আহাম্মদ গুন্নু, পিতা- আবদুল করিম, শফিক (৩০), পিতা-মো. ইসমাইল, উভয়সাং-দেরাজ মিয়াপাড়া, হায়দার আলী (৫০), পিতা- অজ্ঞাত, সাং-পুইট্যা ঝিরি, মোহাম্মদ আজম (৩৫), পিতা- অলু মিয়া, দেলোয়ার (৫৫), জগদীশ, মো. গিয়াস উদ্দিন (৩০), জনি ত্রিপুরা, রনি ত্রিপুরা (৩২), শতিমান ত্রিপুরা (৩৫), চন্দ্রমনি ত্রিপুরা (৩৩), শদুচন্দ্র ত্রিপুরা (৩৫), অবৈদ্য ত্রিপুরা (৩৫), কোরবান আলী, ইউপি সদস্য নাছির উদ্দিন, ফিরোজ, মাহমুদুল (৪৫), পিতা-আবদুল করিম, কোরবান আলী, সর্বসাং-টংগ ঝিরিপাড়া, ৮নং ওয়ার্ড, সর্ব ৫নং সরই ইউনিয়ন, ৩০৩নং ডলুছড়ি মৌজা, থানা-লামা, বান্দরবান পার্বত্য জেলাসহ আরো অজ্ঞাতনামা শতাধিক ব্যক্তি। এসব লুটপাটকারীরা ফেয়ারি এগ্রোর বাগানে সন্ত্রাসী কায়দায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তারা বলে বেড়াচ্ছে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাগানের কেয়ারটেকার প্রধান সোহরাব জানান, ‘এ সকল লুটপাট ও গাছ কাটার বিষয়ে প্রতিটি মুহূর্তে লামা থানার অফিসার ইনচার্জ, কেয়াজুপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ, লামা বন বিভাগের কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করে যাচ্ছি। লিখিতভাবে থানায় এজাহার দায়ের করেছি। দুঃখজনক হলেও সত্য, লামা থানার অফিসার ইনচার্জ আমাদের এজাহারের বিষয়ে কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা না করায় অপরাধীচক্রের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। এ পরিস্থিতিতে ফেয়ারি এগ্রো বাগান এলাকায় বারবার গাছ কাটা, লুটপাট বন্ধ এবং সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়ার দাবি করছি। লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহদাত হোসেন জানান, পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। বাগান উজাড়ের বিষয়টি বন বিভাগেরও দেখার দায়িত্ব রয়েছে। লামা বন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের টিম সকল ধরনের বন উজাড়ের বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছে। ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা ও পরিবেশবাদীদের গুরুত্বসহকারে নজরে আনা দরকার।
"