নাটোর প্রতিনিধি

  ০৬ জানুয়ারি, ২০২৫

উত্তরা গণভবন

প্রাচীন স্থাপত্যকলার অপরূপ নিদর্শন

‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন / আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ নাটোরের রূপ-সৌন্দর্যকে এমনভাবে কবিতার লাইনে তুলে এনেছেন, যেন সবাই ‘বনলতা সেন’কে আজও খুঁজে ফেরে। বনলতা সেনকে খুঁজতে হলে দেখতে হবে নাটোরের রূপ-সৌন্দর্যের মূল উৎসে- উত্তরা গণভবন প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অপরূপ নিদর্শন। প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের সৌন্দর্য মণ্ডিত এ ভবন আজও কালের সাক্ষী হয়ে দঁড়িয়ে আছে। ভবনটির সামনে আসলে সবাইকেই থমকে যেতে হয়। দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল সিংহ দুয়ার। এর উপরে অতিকায় এক ঘড়ি, যা ঘণ্টাধ্বনী বাজিয়ে আজও সঠিক সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ও পরিখার বেষ্টনী, দেশি-বিদেশি দুষ্প্র্রাপ্য বৃক্ষরাজি, ইটালিয়ান গার্ডেনে শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য শোভিত দৃষ্টিনন্দন বিশাল এ রাজপ্রাসাদ।

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাটোরের রাজা রামজীবন ও রানীভবানীর বিশ্বস্ত চৌকস দেওয়ান দয়ারাম রায়। ১৭০৬ সালে রামজীবনের কাছ থেকে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় জমিদারি লাভ করেন। এরপর ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে বগুড়া, পাবনা, জামালপুর ও যশোর জেলার অংশবিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে শাসন করেছে এ রাজবংশ। জেলা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে রাজা দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাচীরের বাইরের ফটকের সম্মুখে রয়েছে ২.৮৯ একর জমি। রাজা প্রমদানাথ রায়ের সময় ১৮৯৭ সালে ১০ থেকে ১২ জুন তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে শুরু হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে যোগ দেন। কিন্তু অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন ১৮ মিনিটব্যাপী প্রলয়ংকরী এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পরে ১৮৯৭ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছরের চেষ্টায় বিদেশি প্রকৌশলী চিত্রকর্ম শিল্পীদের সহায়তায় ৪১.৫০ একর জমির ওপর এ রাজ বংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় মোগল ও প্রাশ্চাত্য রীতি অনুসারে নান্দনিক কারুকার্যময় রাজ প্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ করেন। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার ছাড়াও এখানে রয়েছে মোট ১২টি ভবন। এগুলোর মধ্যে প্রধান রাজপ্রাসাদ, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারি ভবন, রানীমহল, রান্নাঘর, মোটরগ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স উল্লেখযোগ্য।

রাজপ্রাসাদের দক্ষিণে রয়েছে ফুলের বাগান। এ বাগানটি ইটালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুলে পরিপূর্ণ এ বাগান। বাগানের ভেতর শ্বেতপাথরের আকর্ষণীয় ৪টি নারীর ভাস্কর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। রয়েছে একটি ইটালিয়ান ঐতিহ্যের ফোয়ারা এবং লৌহ ও কাঠ দ্বারা নির্মিত বেঞ্চ আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, একটি ডিম্বাকার সাইজের মার্বেল পাথরের নির্মিত আসনসহ মঞ্চ। সমগ্র বাগানে অসংখ্য ফুলের সমাহার। আছে পারিজাত, নাগালিঙ্গম, কর্পুর, এগপ্লান্ট, হৈমন্তীর মতো দুষ্প্রাপ্য সব বৃক্ষরাজি আর কৃত্রিম ঝরনা।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির মূল প্রাসাদটি একতলা। এর মাঝে রয়েছে প্রশস্ত একটি হল রুম। বেশ উঁচু হলরুমের শীর্ষে রয়েছে বিশাল এক গম্বুজ। এ গম্বুজের নিচ দিয়ে হলরুমে সূর্যের আলো প্রবেশ করে। হলরুমের মাঝে রাজার আমলে তৈরি বেশ কিছু সোফা রয়েছে। এ ছাড়াও হলরুমে একটি ব্যতিক্রমী কারুকার্য খচিত সোফা রয়েছে যাতে একসঙ্গে চারজন চারমুখী হয়ে বসা যায়। হলরুমের আসবাবপত্র এখনো রয়েছে। উপরে রয়েছে সেই আমলের ঝাড়বাতি। হলরুমের পাশে রয়েছে আরেকটি বড় ঘর। পাশের রান্নঘর হতে এ ঘরে সরাসরি আসা যায়। নিরাপত্তার জন্য রান্নাঘরের করিডোরের দুপাশে রাজ আমলের তার দিয়ে এখনো ঘেরা রয়েছে। এর পাশে একটি ঘরে রয়েছে সিংহাসন। এর পাশের ঘরটি রাজার শয়নঘর। এ ঘরে এখনো রাজার খাট শোভা পাচ্ছে। কুমার প্যালেসের পেছনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রাগার। দক্ষিণে রানীমহল। আজ আর সেটা নেই। রানীমহলের সামনে একটি ফোয়ারা এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। রাজার একটি চিড়িয়াখানাও ছিল। নাটোরের জেলা প্রশাসন আবার নতুন করে সেই চিড়িয়াখানা চালু করেছে, রাজার ট্রেজারি ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে সংগ্রহশালা। রাজা-রানীর ব্যবহৃত নানাসামগ্রী সংগ্রহ করে দর্শনার্থীদের দেখার জন্য এ সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। মূলভবন রাজপ্রাসাদের সামনে রয়েছে রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আবক্ষমূর্তি। এর দুপাশে রয়েছে দুটি কামান। রাজ প্রাসাদের সামনে পূর্বে রয়েছে রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চারচাকাবিশিষ্ট একটি কালো কামান আজো শোভা পাচ্ছে । রাজপ্রাসাদের প্রবেশ পথে সিঁড়ির দুই পাশে ছিল দুটি কালো কৃষ্ণমূর্তি-যা এখন শোভাবর্ধন করছে সংগ্রহশালার। সংগ্রহশালার প্রবেশ করিডরে রয়েছে ধাতববর্ম। এটা পরেই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারণে পিতলের তৈরি এ বর্মটি দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। রাজপ্রাসাদের উত্তর পাশে ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে অস্টাদশ শতকের রাজবাড়ি আলোতে ঝলমল করত। পুরো রাজপ্রাসাদে ছিল রাজার বিভিন্ন চিত্রকর্ম, ছবি আর বিদেশি ঘড়ি- আজ সেসব আর নেই। প্রাসাদের শ্বেতপাথরের মেঝে মোড়ানো থাকত পার্সিয়ান গালিচায়। রাজা প্রমদানাথ রায়ের প্রচণ্ড রকম ঘড়িপ্রীতি ছিল। আর এ জন্য তিনি দেশ-বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে ঘড়ি তৈরি করে আনতেন। এসব ঘড়ি রাজপ্রাসাদ ছাড়াও বিভিন্ন ভবনে স্থাপন করেছিলেন। এমন একটি ঘড়ি ছিল যাতে ১৫ মিনিট পরপর জলতরঙ্গ বাজত। এ ছাড়া রাজবাড়ির মূলফটকে রয়েছে একটি ঘড়ি। এর দুই পাশে দুটি ডায়াল। ঘড়িটি এখনো সঠিকভাবেই সময় দিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িটি ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা হয়েছিল। আগে এর ঘণ্টাধ্বনী অনেক দূর থেকে শোনা যেত এখন এ ঘণ্টাধ্বনী শোনা যায় প্রায় এক মাইল দূর থেকে। শোনা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হওয়ায় কিছু ঘড়িসহ অন্যান্য মূলবান সম্পদ লুট হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এটাকে গভর্নর হাউস থেকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০৮ সালে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এর বেশিরভাগ অংশ। তবে রাজপ্রাসাদ আর ইটালিয়ান গার্ডেনে প্রবেশ করতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর রাজপ্রাসাদে যেতে হাতের বাম দিকে রাণীঘাট ছাড়িয়ে চোখে পড়ে চিড়িয়াখানা। সেখানে রয়েছে অসংখ্য হরিণ, বানর, ময়ুর, টিয়া পাখি। রাজবাড়ির প্রবেশ পথের ডান পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে শত বছরের শতাধিক আম গাছ- যেখানে স্থাপন করা হয়েছে পাখির অভয়াশ্রম।

সংরক্ষিত রাজপ্রাসাদ ও ইটালিয়ান গার্ডেন ছাড়া উত্তরা গণভবন প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্যে খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। মূল ফটকে প্রবেশ মূল্য সিনিয়র সিটিজেন ১০ টাকা, শিক্ষার্থী এবং দলগত জনপ্রতি ২০ টাকা, সাধারণ ৩০ টাকা, বিদেশি নাগরিক ৬০০ টাকা আর সংগ্রহশালায় প্রবেশমূল্য ৩০ টাকা। সারা বছরজুড়ে গণভবন দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে। তবে শীতে পিকনিকের মৌসুমে এবং দুই ঈদে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে হয় অনেকগুণ। গত অর্থবছরে টিকিট বিক্রি এবং গাড়ি পার্কিং খাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন হিসাব সহকারী নুর মোহাম্মদ।

নাটোরের জেলা প্রশাসক এবং উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আসমা শাহীন বলেন, লেকের পানি এবং মৎস্য ব্যবস্থাপনাসহ ঐতিহ্য-স্থাপত্যের উত্তরা গণভবনের সব সংস্কার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনায় হওয়া উচিৎ। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি মাস্টারপ্লান প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ মাস্টারপ্লানের অধীনে এ ঐতিহ্যকে সুরক্ষা প্রদান করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close