কুমিল্লা প্রতিনিধি

  ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

পরিকল্পিত উদ্যোগে প্রাণ পাবে কুমিল্লা বিমানবন্দর

* ৩০ বছর ফ্লাইট কার্যক্রম বন্ধ * প্রতিদিনই এ বন্দরের সিগন্যাল ব্যবহার করছে দেশ-বিদেশের ৪০ এয়ার বাস * ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে দেশে অন্যতম বিমানবন্দর ছিল কুমিল্লা

পরিকল্পিত উদ্যোগে আবারো প্রাণ ফিরে পেতে পারে কুমিল্লা নগরীর প্রাচীন বিমানবন্দর। তিন দশক ধরে ফ্লাইটের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ধুলাবালি আর ঘাস বিস্তার হয়েছে রানওয়েতে। ভেঙে গেছে পিস ঢালাই ও ব্লক। মূল ফটকের শুরুতেই রয়েছে পুষ্টি ও ডেইরি ফার্ম। আর বাইরের জমিতে ধান ও গমসহ বিভিন্ন ফসল। রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ছোট্ট ঘাঁটি। সেখানে বিমানবন্দরের সাইনবোর্ডসহ ২-৩টি ভবনও রয়েছে।

কুমিল্লা নগরীর ঢুলিপাড়া, নেউরা ও রাজাপাড়া এলাকায় অবস্থিত এ বিমানবন্দরটির আয়তন ৭৭ একর। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত থাকায় রানওয়ের শক্তি পিসিএন (পেভমেন্ট ক্ল্যাসিফিকেশন নম্বর) নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ধুলাবালি আর ঘাসের বিস্তার হয়েছে। ভেঙে গেছে পিস ঢালাই ও ব্লক। যত্নের অভাবে এগুলোর রুগ্ন দশা। প্রশাসনিক শাখার সাইনবোর্ডটি না থাকলে বিমানবন্দরের অস্তিত্বও বোঝা কঠিন।

সূত্র জানায়, সর্বশেষ ১৯৯৪ সাল থেকে এখানে দেখা নেই বিমানের। অবশ্য কিছু যন্ত্রপাতি এখনো বিদ্যমান। পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে আবারো প্রাণ ফিরে পেতে পারে প্রাচীন এ বিমানবন্দরটি। এমনটিই মনে করছেন বিমান কর্তৃপক্ষ ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিনিধিরা। তাদের দাবি বিমান ওঠা-নামা বন্ধের সময় আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। ইপিজেড ও রেমিট্যান্স আয়ে কুমিল্লার শক্ত অবস্থানের কারণে বর্তমানে এটি সচল করা সময়ের দাবি।

বিমান সূত্রে জানা যায়, অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ১৯৪১-৪২ সালে কুমিল্লা শহরতলীর দক্ষিণে ৩ কিলোমিটার দূরে নেউরা, ঢুলিপাড়া ও রাজাপাড়া এলাকার ৭৭ একর জমিতে এ বিমানবন্দরটি স্থাপন করে ব্রিটিশ সরকার। এখান থেকে ব্রিটিশরা কিছু যুদ্ধ বিমান ওঠা-নামা করত জাপানি বিমানকে পাহারা দেওয়ার জন্য। মাঝে পাকিস্তান আমলসহ ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটে মোটামুটি বিমান চলাচল করত এখান থেকে। পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে প্রাচীন এ বিমান বন্দরটির কার্যক্রম শিথিল হয়ে যায়। অবশ্য ১৯৯৪ সালে আবারো চালু করা হয়। কিন্তু তখন পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় দুসপ্তাহের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় এটি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ফ্লাইট বন্ধ। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে দেশে যে কটি বিমানবন্দর রয়েছে, একসময় কুমিল্লা বিমানবন্দর ছিল তার অন্যতম। তবে বিমান ওঠা-নামা না করলেও এটি এখনো চালু অবস্থাতেই আছে। সক্রিয় রয়েছে সটটেক অব ল্যান্ড ল্যান্ডিং (স্টক)। প্রতিদিনই এ বন্দরের সিগন্যাল ব্যবহার করছে দেশ-বিদেশের কমপক্ষে ৪০টি এয়ার বাস। যা থেকে মাসে কমপক্ষে ২৫-৩০ লাখ টাকার রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। এখান থেকে আন্তর্জাতিক রুটের সবচেয়ে বেশি সিগন্যাল ব্যবহার করে ভারতের অভ্যন্তরীণ রুট, ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুরের বিমান। তাছাড়াও আগরতলা বিমানবন্দরে যাওয়া বিমানও এ রুটে চলাচল করে। এ বিমানবন্দরটির নেভিগেশন ফ্যাসিলিটিস, কন্ট্রোল টাওয়ার, ভিএইচএফ সেট, এয়ার কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি, ফায়ার স্টেশন ও ফায়ার সার্ভিসসহ সব সুবিধাই রয়েছে। কর্মরত রয়েছেন ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যাত্রীদের জন্য আলাদা কক্ষও আছে। সব সুবিধা থাকার পরও শুধু উদ্যোগের অভাবে ৩ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিমান উড়ছে না। এটি নিয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপও নেই।

কর্তৃপক্ষ জানায়, এটি চালু করতে খুব বেশি অর্থেরও প্রয়োজন নেই। শুধু উদ্যোগ নিয়ে রানওয়ে মেরামত, ফায়ার সার্ভিস ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের কয়েকজন জনবল নিয়োগ করলেই এ বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে স্টল বিমান চলাচলের পাশাপাশি কলকাতা, আগরতলাসহ বিভিন্ন রুটে যেকোনো সময় ফ্লাইট চালু করা সম্ভব। এজন্য ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দই যথেষ্ট।

যাত্রী সংকটের কারণে ১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় দফায় কুমিল্লা বিমানবন্দরের ফ্লাইট স্থগিত করা হয়। সেই থেকে আর চালু হয়নি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে নানাদিক থেকে এগিয়েছে কুমিল্লা ইপিজেড ও বিসিক শিল্প নগরীসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে রয়েছে শতাধিক কলকারখানা। যেখানে ব্যবসায়িক কাজে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আসা-যাওয়া করতে হয়। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন এ জেলার অর্ধলাখের বেশি জনশক্তি। এখানেই রয়েছে বার্ডসহ রাষ্ট্রীয় সবধরনের প্রতিষ্ঠান। বাস্তবায়নের পথে কুমিল্লা বিভাগ।

এসময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তারপরও ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা থেকে সড়কপথে কুমিল্লায় যাতায়াত করতে অনেক সময় যানজটের কবলে পড়তে হয়। অথচ বিমানপথে মাত্র ২৫ মিনিটে ঢাকা-কুমিল্লা যাতায়াত করা সম্ভব। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। কুমিল্লা ছাড়াও এর দ্বারা উপকৃত হবে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের মানুষ।

কুমিল্লার বিসিক শিল্পনগরীর সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত তিন দশকে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ফেনী পর্যন্ত অসংখ্য কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন চীন ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা। সড়কপথে চলাচল করতে অনেক সময় তাদের সময়ের অপচয় হয়। বিমান যোগাযোগ থাকলে হয়তো এমনটি হতো না। বন্ধ বিমান চালু হলে ইপিজেড ও বিসিক শিল্পনগরীতে বিদেশি বিনিয়োগ আরো বাড়বে।

জেলা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল খন্দকার বলেন, বন্ধ বিমানবন্দরটি উন্মুক্ত হলে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে এটি চালু করা দরকার।

কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ডা. আজম খান নোমান বলেন, কুমিল্লায় দিন দিন ব্যবসা ক্ষেত্রের পরিধি বাড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝামাঝি হওয়ায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চোখ কুমিল্লার দিকে। যাতায়াত ব্যবস্থা আরো উন্নত হলে তাদের জন্য সুবিধা। তাছাড়াও ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে কর্মরত কুমিল্লার জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও ১৩ শতাংশের বেশি। সুযোগ পেলে তারাও বিমানে চড়বেন। তাই বন্ধ বিমান ফ্লাইট পুনরায় চালু করা সময়ের দাবি।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি অধ্যাপক নিখিল চন্দ্র রায় বলেন, কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। এখানে সব কিছুই আছে। বন্ধ বিমান বন্দরটি চালু হলে আমাদের সমৃদ্ধি আরো বাড়বে।

কুমিল্লার বিশিষ্ট নারী নেত্রী রোকেয়া বেগম শেফালী বলেন, কুমিল্লা বিমানবন্দর সচলের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে। তারপরও অদৃশ্য কারণে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিমানবন্দরের সিএনএস প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ফ্লাইট স্থগিত থাকলেও এটি এখনো সরকারের লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কারণ সিগন্যাল ব্যবহার করে প্রতিদিনই রাজস্ব আয় হচ্ছে। আর ফ্লাইট চালু হলে কুমিল্লার গুরুত্ব আরো বেড়ে যাবে। বাড়বে মানুষের কর্মসংস্থান। পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে তা আবারো প্রাণ ফিরে পাবে। আমরাও চাই ফ্লাইট চালু হোক।

বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ফ্লাইট চালু না থাকলেও প্রতিদিনই এখান থেকে সিগন্যাল ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক রুটের ৩৫-৪০টি বিমান। এতে প্রতি মাসে এখান থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয় দুই-আড়াই কোটি টাকা। যা সম্পূর্ণ তদারকি করছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বর্তমানে আমাদের এখানে জনবল রয়েছে ২৪ জন। রানওয়ে মেরামতসহ কিছু যন্ত্রপাতি স্থাপনের পাশাপাশি আরো ২০-২২ জন লোকবল নিয়োগ দিলে যেকোনো সময় ফ্লাইট চালু করা সম্ভব। এ বিষয়ে আমরাও চেষ্টা করছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close