প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থানগাথা
নিজের উপার্জনে ঘর বানানো হলো না শহীদ সাব্বিরের
পৈতৃক ভিটায় ঘর বানাতে চেয়েছিলেন সাব্বির। নিজের উপার্জনে বানাবেন সেই ঘর। কিন্তু তা আর হলো না। স্বপ্নপূরণ না করেই তাকে পাড়ি জমাতে হয়েছে পরপারে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে কুমিল্লার দেবিদ্বার নিউমার্কেট এলাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল হয়। এতে অন্যদের সঙ্গে যোগ দেন ১৯ বছরের তরুণ সাব্বির। তবে বেলা ১১টায় মিছিলটি শুরু হওয়ার পর থেকেই এলোপাতাড়ি গুলি করে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন কমপক্ষে ১০-১২ জন। তাদের মধ্যে সাব্বিরের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগে।
তখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। কিন্তু অবস্থার অবনতি দেখে চিকিৎসক তাকে কুমিল্লা মেডিকেলে রেফার করেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় তাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স কুমিল্লায় যাওয়ার পথে দেবিদ্বারে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আবারও হামলা করে। এ সময় কুমিল্লায় নেওয়া ঠেকাতে অ্যাম্বুলেন্সটিও ভাঙচুর করা হয়। তারপর আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে কুমিল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সাব্বিরের শরীর থেকে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছিল। পরিস্থিতি খারাপ দেখে কুমিল্লা মেডিকেলেও তাকে রাখা হয়নি। আর ঢাকা মেডিকেলেও তখন নেওয়ার পরিবেশ ছিল না। তাই ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে সিটিস্ক্যান করে তার মাথার ভেতরে গুলি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন চিকিৎসক। পরে অস্ত্রোপচার করে সাব্বিরের মাথার ভেতর থেকে গুলি বের করা হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকেন সাব্বির। কিছু দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হলে ১১ সেপ্টেম্বর দেবিদ্বার ভিংলাবাড়িতে মামার বাসায় ফিরিয়ে আনা হয় তাকে।
মা রিনা বেগম জানান, ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে হঠাৎ মাথা ঝিমঝিমসহ নিজের অস্বস্তির কথা জানান সাব্বির। এ কথা বলতে বলতেই বিছানায় অবসন্ন হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কিশোর সাব্বির পড়াশোনা করতেন কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার মরিচাকান্দা জিয়া স্মৃতি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে, নবম শ্রেণিতে। তবে তিন বছর আগে বাবা আলমগীর হোসেন মারা যাওয়ায় সংসারের অভাব-অনটন গোছাতে মাঝেমধ্যে সিএনজি অটোরিকশা চালাতেন। পৈতৃক বাড়ি পাশের উপজেলা মুরাদনগরের কাজিয়াতল এলাকার হলেও ছোটবেলা থেকেই দেবিদ্বারের ভিংলাবাড়িতে বাবা-মাসহ নানা বাড়িতে থাকতেন। মা রিনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তিন ভাই-বোনের মধ্যে সাব্বির ছিল সবার বড়। তাকে হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। তার স্বপ্ন ছিল আর্থিক সচ্ছলতা ফিরলে পৈতৃক বাড়ি মুরাদনগরের কাজিয়াতলায় একটি ঘর নির্মাণ করে সেখানে ফিরে যাবেন। অথচ তার আগেই সে না ফেরার দেশে চলে গেল। তিনি জানান, সাব্বিরের আরো দুই ভাই-বোন রয়েছে। এর মধ্যে ছোট ভাই সিয়াম (১৩) স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে আর ছোট বোন সামিয়া আক্তার (৮) প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে।
তিনি আরো জানান, সাব্বিরের মৃত্যুর পর তেমন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তবে তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ২ লাখ টাকার চেক দিয়ে যান। এছাড়া গত ২৯ অক্টোবর তুরস্ক থেকে নেতাকর্মীদের মাধ্যমে নগদ ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও মুরাদনগরের সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ। রিনা বেগম আরো জানান, তাদের একটি ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছেন কায়কোবাদ। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সাহায্য-সহযোগিতা নয়, তিনি ছেলে হত্যার বিচার দেখতে চান। সাব্বিরের মামা এনামুল জানান, গত ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় তার ভাই নাজমুল (সাব্বিরের বড় মামা) বাদী হয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা করেন। এতে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের তৎকালীন এমপি আবুল কালাম আজাদ ও সাবেক এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ৯৯ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে সাব্বিরের মৃত্যুর পর আর মামলা হয়নি। বর্তমানে হত্যা মামলার প্রস্তুতিও চলছে বলে তিনি জানান।
কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও আগামী নির্বাচনে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী এ এফ এম তারেক মুন্সী বলেন, সাব্বির মুরাদনগর উপজেলার বাসিন্দা হলেও সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে দেবিদ্বারে। তাই দায়বদ্ধতা থেকেই আমরাও তার পাশে রয়েছি। মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, সাব্বির গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই তুরস্ক থেকে তার খোঁজখবর রাখছেন, মুরাদনগর থেকে নির্বাচিত পাঁচ ারের সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ। এরই মধ্যে তিনি তার পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা অনুুদান দিয়েছেন। আর সাব্বিরের স্বপ্ন অনুযায়ী গ্রামের বাড়ি কাজীয়াতলায় তার পরিবারের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছেন। ভবিষ্যতেও মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি তার পরিবারের পাশে থাকবে বলে জানান তিনি। মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত উদ্দিন বলেন, সাব্বিরের পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারের তালিকা চাওয়া হয়েছে। আমরা সাব্বিরের নামও পাঠিয়েছি। অন্যরা সরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেলে তার পরিবারও পাবে।
"