তুহিন আহমদ, সিলেট
আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু মজুদ নেই ওষুধের
সিলেট মহানগরীর খাল, নালা, নর্দমায় তৈরি হয়েছে মশার প্রজননক্ষেত্র। পাওয়া যাচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। সেইসঙ্গে বেড়েছে মশার উপদ্রব। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৪ জনের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এতে নগরীজুড়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক বিরাজ করছে। অন্যদিকে জনবল সংকটে যথাযথভাবে মশকনিধনের ওষুধ ছিটাতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নগর কর্তৃপক্ষ।
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, নগরে সাড়ে ৭ লাখ মানুষের বাস। ৪২টি ওয়ার্ডে বিভক্ত এ সিটির মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন মাত্র ৩ কর্মচারী। তবে সিজনে দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন ৯০ জন। মশা তাড়াতে আধুনিক সরঞ্জাম বলতে রয়েছে ২০টি ফগার মেশিন। আর রয়েছে ১০০টির মতো হস্তচালিত স্প্রে। তবে যারা এসব পরিচালনা করছেন, তাদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ। ফলে তারা জানেন না, কোথায় কোন প্রজাতির মশা রয়েছে, কোন মশার জন্য কী ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। কীটনাশক প্রয়োগের মাত্রার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা কতটুকু, তা-ও তাদের জানা নেই। সিসিকের স্বাস্থ্য শাখার তথ্যমতে, সম্প্রতি চালানো এক অভিযানে ৪২টি ওয়ার্ডেই কমবেশি এডিস মশার লার্ভার সন্ধান মিলেছে। নগরবাসীর অভিযোগ, সিসিক থেকে যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তাতে মশা মরছে না; বরং বিভিন্ন ড্রেন ও খালে থাকা তেলাপোকা বাসা বাড়িতে এবং রাস্তায় এসে মারা যাচ্ছে। নগরবাসীর অভিযোগ নগরের বেশিরভাগ ওয়ার্ডে এখনো দেখা যায়নি সিসিকের ডেঙ্গু প্রতিরোধের কার্যক্রম। নামমাত্র ওষুধ ছিটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন তারা। তবে সিসিকের স্বাস্থ্য শাখার কর্মকর্তারা বলেন, জনবল সংকটে সময়মতো ওষুধ ছিটাতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবু তারা নিয়মিত ওষুধ ছিটানো ও অভিযান পরিচালনা করছেন।
সিসিকের স্বাস্থ্য শাখা সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি নগরের তিনটি ওয়ার্ডের প্রায় ৪০০ স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা অনুসন্ধানে ৫৪টি স্থাপনায় এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে বছরজুড়ে সমন্বিতভাবে মশকনিধন ও জনসচেতনতা দরকার। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এটা বেশি জরুরি। নগরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি, অফিস সবখানেই মশার উপদ্রব বেড়েছে। এজন্য নগরবাসী কয়েল, মশা মারার ব্যাট, অ্যারোসলসহ নানা পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। ভবনের নিচতলার বাসিন্দারা মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে দিনে রাতে সবসময় জানালায় নেট লাগিয়ে রাখছেন।
নগরের জালালাবাদ এলকার বাসিন্দা নোমান আহমেদ বলেন, মশার উৎপাত এতই বেশি যে, সন্ধ্যার পর ছেলে মেয়েকে মশারির মধ্যে রাখতে হয়। মশার জ্বালায় বাসায় কোথাও একটানা বসে থাকা যায় না। সরেজমিন সিলেটের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় দেখা গেছে, গাড়িরটায়ার, টিউব ও যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। টার্মিনালের রাস্তার দুই পাশের ড্রেন ও নালায় অসংখ্য প্লাস্টিকের কাপ, পানির বোতল, ককশিটের বাক্স, ডাবের খোসা জমে আছে। এগুলোয় ব্যাপক মশা জন্মায়। ঝালোপাড়া এলাকার গৃহিণী নাবিলা বেগম বলেন, সন্ধ্যার পর বাইরে বের হলে মশা যেভাবে ঘিরে ধরে, মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। দিনেও মশা কামড়ায়। ২৪ ঘণ্টা কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। মশার যন্ত্রণায় বাচ্চারা পড়ার টেবিলে বসতে পারে না। কয়েলেও কাজ হয় না।
মদিনা মার্কেট বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, আগে দেখতাম সন্ধ্যা হলে মশার উৎপাত শুরু হয়, এখন দিনরাত সমান তালে মশা কামড়ায়। সন্ধ্যার পর অত্যাচার চরমে পৌঁছে। সন্ধ্যার পর কয়েল ছাড়া ঘরে থাকা যায় না। নগরীর ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের দুসকি এলাকার তামিম আহমদ বলেন, ডেঙ্গুর উপদ্রব বাড়লেও এ এলাকায় কোনো ওষুধ ছিটাতে দেখা যায়নি। এমনকি লিফলেট বা মাইকিং করে স্থানীয়দের সচেতনও করা হয়নি। ব্যবসায়ী কালাম মিয়া বলেন, দিনে মশা কম থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে দোকানে বসা যায় না। বাধ্য হয়ে কয়েল জ্বালিয়ে দোকান করতে হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট লোকজন বলছেন, নভেম্বরেই সিলেট বিভাগে ৩৩১ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। চলতি মাসেও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সিলেট বিভাগে গত বছর ১ হাজার ৪৩৫ জন। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ২৯৯ জন। তবে এ বছর সিলেটে ডেঙ্গুতে মারা যায়নি। সর্বশেষ গত সোমবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ২০ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে সিলেট বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩১ জন। এর মধ্যে সিলেটে ৮০, সুনামগঞ্জে ৩৯, মৌলভীবাজারে ৩০ এবং হবিগঞ্জে ১৭৩ জন। সিলেট সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য শাখা জানায়, এ বছর ৫ হাজার লিটার ওষুধ ছিটানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ না থাকায় মশকনিধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
সিসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় এখনো ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কম, তবে শঙ্কা আছে। এ বছর ৫ হাজার লিটার ওষুধ ছিটানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ না থাকা ও নানা সংকটের কারণে মশকনিধন কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ডেঙ্গু থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সমন্বিতভাবে মশকনিধন কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। এডিস মশা শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় নয়, প্রত্যন্ত এলাকায়ও ছড়িয়েছে। তাই একযোগে মশকনিধন কার্যক্রম চালালে ভালো ফল আশাকরা যায়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নগরের সবখানেই মশার উৎপাত। এ বছর এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম চোখে পড়েনি। আর এখন ওষুধেও মশা মরে না। এখনই আগাম ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য আলাদা কর্ণার করা হয়েছে। সেখানে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
"