প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
পার্বত্য তিন জেলায় যেসব কারণে অশান্তি
বিবিসির প্রতিবেদন
পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ড এবং তার পরদিনই তার শেষকৃত্যে যাওয়ার পথে আরো পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে উত্তেজনা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য অনেকেই সরকারকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। আবার অনেকে দাবি করছেন, ক্ষমতা ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর দ্বন্দ্বে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি আরো রক্ত ঝরেছে বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায়। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় আক্রমণকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনজন। স্থানীয় পুলিশ নিহতদের ইউপিডিএফের কর্মী বলে নিশ্চিত করেছে।
১. শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন : দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াই এর পর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের শান্তিচুক্তি সই হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে ২০ বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু এই চুক্তির কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা নিয়ে আছে বড় ধরনের বিতর্ক। সরকার পক্ষ বলছে, বাস্তবায়নের কাজ চলছে। কিন্তু পাহাড়িদের অভিযোগ-চুক্তিতে তাদের যেসব অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল তার কিছুই তারা এখনো পায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষক ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলছেন, ‘পাহাড়িদের স্বশাসন দেওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল যে তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। কিন্তু সে রকমটা হয়নি। তাদের অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা ছিল কিন্তু সেসব বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে একটা হতাশা তৈরি হয়েছে।’
কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকারের সঙ্গে এই চুক্তি হয়েছিল, সেই সরকারের দাবি ছিল- চুক্তির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যেসব এখনো হয়নি সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, গত সরকারের কথা ও কাজে মিল ছিল না।
২. আঞ্চলিক ও পার্বত্য পরিষদের নির্বাচন : শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের পরের বছরই গঠিত হয়েছিল আঞ্চলিক পরিষদ। এসব প্রতিষ্ঠানের নেতারা বলছেন অন্য কথা। সেখানে আগে থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে আসছিল সেগুলোর সঙ্গে এসব নতুন প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক ও আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
৩. ভূমি সমস্যা : পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির মালিকানা নিয়ে আছে বিশেষ কিছু আইন। ব্রিটিশ আমলের সেসব আইন অনুসারে ভূমির মালিকানা প্রথাগতভাবে সেখানে যারা বসবাস করে আসছে সেসব পাহাড়ি মানুষের। এসব ভূমির মালিকানার কোন দলিলপত্র নেই তাদের কাছে। কিন্তু পরে বাঙালিদের যখন সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদের জন্যে বসতি গড়ে দেওয়া হলো তখন শুরু হলো ভূমি নিয়ে বিরোধ, যাকে দেখা হয় সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে। পাবর্ত চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষক আমেনা মহসিন বলছেন, ‘শান্তিচুক্তির মধ্যেই অনেক সমস্যা ছিল। চুক্তিতে ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে কিন্তু সেখানে বাঙালি সেটেলারদের কথার কোন উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এদের কারণেই তো ভূমি নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছিল।’
এই সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০১ সালে গঠিত হয়েছিল ভূমি কমিশন। কিন্তু গত ১৭ বছরে তারা একটি বিরোধেরও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। শুরুতে যে আইন তৈরি করা হয়েছিল সেটা নিয়েও ছিল অনেক সমস্যা। দেড় দশক পাল্টাপাল্টি বিতর্কের পর সেই আইনের সংশোধন হয়েছে ২০১৬ সালে। কিন্তু সেই আইন কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার জন্য যেসব রুলস বা বিধিমালার প্রয়োজন সেগুলো এখনো তৈরি হয়নি।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘এই আইন সংশোধন হতেই লেগে গেল ১৫ বছর। বিধিমালা হলো না এখনো। এ থেকে বোঝা যায় যে ভূমি কমিশন কার্যকর করার ব্যাপারে গত সরকার কতটা আন্তরিক ছিল।’
৪. সেনাবাহিনীর উপস্থিতি : চুক্তিতে ছিল যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছটি ক্যান্টনমেন্ট থাকবে। কিন্তু এর বাইরে সেখানে অস্থায়ী যত ক্যাম্প আছে সেগুলো সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু পাহাড়িদের অভিযোগ- চুক্তি অনুযায়ী সেসব করা হয়নি। পাহাড়ি সংগঠনগুলোর হিসেব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে চারশরও বেশি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। কিন্তু তাদের অভিযোগ যে এসব ক্যাম্পের মাত্র ৩৫টি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘আমাদের কথা হলো সেনাবাহিনী সেখানে থাকবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর শাসন থাকবে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে ক্যান্টনমেন্ট আছে কিন্তু সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো সেনা শাসন নেই।’ আমেনা মহসিন বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতো তাহলে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকার প্রয়োজন ছিল না।
৫. পাহাড়িদের বিভেদ : শান্তিচুক্তি হওয়ার পর থেকে গত ২০ বছর পাহাড়িদের সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায় এবং তাতে খুনোখুনিও হয়। চুক্তি হয়েছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বা পিসিজেএসএস সংগঠনের। ১৯৯৭ সালেই চুক্তির বিরোধিতা করে তৈরি হয়েছিল ইউপিডিএফের। সম্প্রতি সেটাও ভেঙে গঠিত হয়েছে নতুন আরেকটি গ্রুপ- ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক।
৬. বাঙালিদের বসতি ও অবিশ্বাস : সত্তরের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র লোকজনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। বলা হয় পাঁচ লাখের মতো বাঙালিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের আমলেই নেওয়া হয়েছিল চার লাখের মতো। সেই সংখ্যা এখন বেড়ে কত হয়েছে তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা বলেন, চার দশকেরও বেশি সময় পর পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালির সংখ্যা এখন প্রায় সমান সমান। পাহাড়ি তিন জেলায় এই বাঙালিদের বলা হয় সেটলার।
আমেনা মহসিনের মতে, ‘বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে তাতে সেখানে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে আস্থা তৈরি হওয়া সম্ভব না। এখানে হয়তো নানা ধরনের এনজিও কাজ করছে। তারা পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বৈঠক করাচ্ছে। এভাবে বৈঠক করিয়ে তো আর আস্থা তৈরি করা যায় না।’
৭. পিছিয়ে পড়া উন্নয়ন ও দুর্গম এলাকা : অনেকেই বলেন, সারা দেশে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে সেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়নি। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে উন্নয়নের জন্যে সেখানে যে বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ছিল গত সরকার তা করেনি।
অস্থিরতার পেছনে আরো একটি কারণ হচ্ছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। প্রত্যন্ত, দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা হওয়ার কারণে নিরাপত্তা বাহিনী খুব দ্রুত ও সহজে সেখানে পৌঁছাতে পারে না। গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন সেতুও বিশেষ করে বান্দরবানে। সাজেকের মতো দুর্গম এলাকাতেও তৈরি হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো এ রকম দুর্গম জায়গা রয়ে গেছে যেখানে যেতে হয় পায়ে হেঁটে এবং সেসব জায়গায় পৌঁছাতে দু-তিনি দনও লেগে যেতে পারে।
"