মো. মনিরুজ্জামান মনির

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

অতিথি কলাম

রেলওয়ের সংস্কার-উন্নয়নে দরকার রেলেরই লোক

রেলওয়ের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক, যেমনটা ভাইয়ের সঙ্গে ভাই-বোনের কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের। এই সম্পর্কের অন্যতম কারণ আমার বাবা রেলওয়ের কর্মী ছিলেন। রেলওয়ের টাকায় আমাদের অন্ন জুটেছে। আমার শরীরে যে রক্ত প্রবাহিত তা রেলওয়ের টাকায় কেনা খাদ্য থেকেই। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে ট্রেন দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। শৈশব থেকে কৈশোর পার করেছি ট্রেনের সঙ্গে খুঁনসুটি করে। আহ্! কত মধুর স্মৃতি। মনের অজান্তেই রেলওয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই রেলওয়েকে কতটা ভালোবাসী, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবে এতটুকু বলতে পারি, আমার শরীরকে আমি যতটা ভালোবাসী, আমার সন্তানকে যতটুকু ভালোবাসী, রেলওয়েকে তার চেয়ে একবিন্দু কম ভালোবাসী না। আর সেই কারণেই রেলওয়ের দৈন্যদশা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। বাংলাদেশে লোকসানি খাত হলো রেলপথ। অবহেলিতও বটে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন রেলওয়ের এ দৈন্যদশা?

আলোচনার আগে প্রতিবেশী ভারতের দিকে একটু নজর দিতে চাই। সেদেশে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে রেলপথ। দেশটিতে রেলওয়ের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সরকারের নানান উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ভারতীয় রেলসেবার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে। দিল্লি সরকারের লাভজনক প্রকল্পও এটি।

শুধু ভারত নয় চীন, রাশিয়া, জাপান, কানাডা, যুক্তরাজ্য, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও জনপ্রিয় পরিবহন মাধ্যম হলো রেলপথ। এসব দেশেও রেল লাভজনক। উল্টোটা কেবল আমাদের দেশে। এদেশে লোকসানি খাত হচ্ছে রেলপথ। চরম অবহেলিতও বটে। এ লোকসানের পেছনে অন্যতম কারণ হলো পরিকল্পনার যথেষ্ট ঘাটতি এবং বিশেষ করে ম্যানেজমেন্ট লেভেলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকের অভাব। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রেলওয়ের উন্নয়নে অনেক প্রকল্প হাতে নিলেও তেমন লাভ হয়নি। অবকাঠামোর কিছু উন্নয়ন হলেও সেবার মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। কেন না, সেখানে কেনাকাটাসহ অনেক ক্ষেত্রে লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগবাণিজ্য ছিল অনেকটা ওপেন-সিক্রেট।

রেলওয়ের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, শীর্ষ পর্যায়ে অন্য খাতের (জেনারেল শিক্ষিত) লোকজন বসানো। ফলে রেলওয়ের নেতৃত্বের অভাব স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও পূরণ হয়নি। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, দেশের শীর্ষ স্থানীয় একজন ডাক্তারকে যদি রেলওয়ের মহাপরিচালক কিংবা মন্ত্রী করা হয়, তাতে তেমন লাভ হবে? না হবে না। কারণ এটা বিশেষায়িত সেক্টর। এখানে টেকনিক্যাল লোকের দরকার। অতীতের সরকারগুলো এক্ষেত্রে ভুল করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ রেলমন্ত্রী ছিলেন জিল্লুল হাকিম। তিনি একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিক বটে, কিন্তু তাতে কী? রাজবাড়ীর এই ‘রাজা’র রেলের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। কয়েকটা লম্বা হাঁক-ডাক দেওয়া ছাড়া ৮ মাসে তিনি তেমন কিছুই করতে পারেননি। এর আগে আওয়ামী লীগের রেলপথমন্ত্রী ছিলেন নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি একজন আইনজীবী। আইন পেশায় তার যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। তিনি রেলওয়ের উন্নয়নে তেমন কিছুই করতে পারেননি। আর পারবেনইবা কী করে? আইনজীবী হয়ে রেলওয়ের কিইবা বোঝেন?

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করেছে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে। তিনি অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব। তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইউএনডিপি, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন। একজন ভালো, সৎ ও বিচক্ষণ মানুষ হিসেবে তার তুলনা বিরল। তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তিনিওতো রেলওয়ের লোক নন- একথা অবশ্যই বলা যায়। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়েও রেলপথ মন্ত্রণালয় নিজস্ব (এই খাতে অভিজ্ঞ, কাজ করা) উপদেষ্টা পেল না। এটা রেলওয়ের উন্নয়নে অন্তরায় হিসেবেই আমি মনে করি। এছাড়া ফাওজুল কবির খানের আরো দুটি মন্ত্রণালয় আছে। ফলে তিনি সপ্তাহে একদিন এ মন্ত্রণালয়ে অফিস করেন বলে জানা গেছে। এতে কাজের ব্যাঘাত ঘটছে বলেই মনে হয়। রেলওয়ের জন্য আসলে দরকার এ খাতের বিচক্ষণ লোক, যিনি সবসময় এ মন্ত্রণালয় নিয়ে থাকবেন। এক্ষেত্রে আমার মতো অনেকের প্রস্তাব হচ্ছে- রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহাদাত আলীকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হোক। আগামী ৮ ডিসেম্বর তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে যাচ্ছেন। তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে রেল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পদে তাকে বসানো যেতে পারে। কেন না রেলওয়ে হচ্ছে সরকারের একটি বিশেষায়িত কারিগরি প্রতিষ্ঠান। দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থায় এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষায়িত এ প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ৩০ বছর বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সরদার সাহাদাত আলী অভাবনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি বিভিন্ন স্তরে কর্মরত থেকে রেলওয়ে অপারেশন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, রেল নেটওয়ার্কিং, বাণিজ্যিক কার্যক্রম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, স্টোরস ম্যানেজমেন্ট এবং পরিবহন ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত চৌকস হয়ে উঠেছেন। দক্ষতার সঙ্গে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হলে তিনি রেলওয়ের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হবেন বলেই বিশ্বাস করি। এটা শুধু আমার একার বিশ্বাস নয়। এ বিষয়ে রেলওয়ের সবাই একমত পোষণ করবেন বলেই আশা করি।

অনেকে আবার প্রশ্ন করতে পারেন- একজন ডিজি কী উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? হ্যাঁ, পারবেন। অবশ্যই পারবেন। না পারার কোনো কারণ নেই।

ড. শামসুল আলমের কথা কি মনে আছে? তিনি একজন অধ্যাপক। পরিকল্পনা কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন তিনি। সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ডেল্টা পরিকল্পনাসহ অনেক পরিকল্পনায় তার অবদান অনস্বীকার্য। চাকরি থেকে অবসরে গেলে ২০২১ সালে সরকার তাকে টেকনোক্র্যাট কোটায় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী করেছিল। মূলত তার মেধা, অর্জিত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতেই তাকে প্রতিমন্ত্রীর আসনে বসানো হয়। তিনি বেশ ভালোভাবেই দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এবার আসি অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনের কথায়। তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন। তাকেও টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করা হয়, অর্থাৎ তিনি এমপি ছিলেন না। তিনি মূলত একজন চিকিৎসক। বার্ন চিকিৎসায় তিনি এশিয়ার মধ্যে শীর্ষ চিকিৎসকদের একজন। যারা ভারত ও থাইল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য গেছেন, তাদের অনেকেই সামন্ত লাল সেনের প্রশংসা শুনেছেন ওইসব দেশের চিকিৎসকদের কাছে। তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর খুব সুচারুভাবেই তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তাকে কেউ কোনো প্রকল্পের ব্যাপারে ভুল বোঝাতে পারেননি। কেন পারেননি? কারণ তিনি এ সেক্টরের লোক। প্রতিটি বিষয় তার নখদর্পণে ছিল। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। ফলে তার মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি ও অপচয় কমে গিয়েছিল কল্পনাতীতভাবে। একইসঙ্গে কাজের গতিও বেড়েছিল।

তাই রেলের উন্নয়নে, রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ সরদার সাহাদাত আলীকে অন্তর্বর্তী সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হোক, এটা আমাদের প্রাণের দাবি। এতে রেলওয়ে লাভবান হবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন খাতে সংস্কার। আর এটা তিনি করতে চান অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করতে। রেলওয়ের সংস্কারের জন্য সরদার সাহাদাত আলী তার একজন সহযোদ্ধা হতে পারেন।

লেখক : সভাপতি, রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close