আল মামুন টুটু, বুড়িচং (কুমিল্লা)

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

আনন্দপুরে সেই আনন্দ নেই

কুমিল্লার বুড়িচংয়ের বাকশীমূল ইউনিয়নের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামের নাম আনন্দপুর। একযুগ আগেও এ গ্রামে দেশি-বিদেশিদের আনাগোনা ছিল। বাঁশের তৈরি নান্দনিক জিনিসপত্র কেনার উদ্দেশ্যে এ পর্যন্ত ২০টিরও বেশি দেশের মানুষ এসেছেন এ গ্রামে। শুধু বিদেশি পর্যটক নয়, বিদেশি সংস্থাগুলোরও পদচারণায় মুখর থাকত গ্রামটি। আনন্দপুর ও আশপাশের গ্রামের ৩ শতাধিক পরিবারযুক্ত ছিল এই কুটির শিল্পের সঙ্গে। গ্রামজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। দূরদূরান্তের মানুষ ভিড় করতেন এ গ্রামে। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির ধুম পড়ে যেত। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল বেশ। সময়ের বিবর্তনে আনন্দপুরের সেই আনন্দঘন আবহ ম্লান হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত চাহিদা থাকলেও দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তির অভাবে এ শিল্পের উৎপাদন কমে গেছে।

বর্তমানে মাত্র ১১টি পরিবার এ পেশায় যুক্ত আছে। তাদের মধ্যে ১ জন মোহাম্মদ শাহ্ জামাল। তিনি কুমিল্লা আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট্সের স্বত্বাধিকারী। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আবুল হাসেমের হাত ধরেই বুড়িচংয়ে এ শিল্প বিস্তার লাভ করে। এ শিল্পকে বাঁচাতে পরিবারের হাল ধরতে শাহ্ জামাল সংগ্রাম করছেন। তিনি আবারো ইউরোপ, আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে চান তার বাঁশের শো-পিস। সরেজমিনে শাহ্ জামালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রংতুলি দিয়ে বাড়ির মাটির ঘরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতে আল্পনা করছেন। আল্পনা দিয়ে আঁকানো ওয়ালমেট উঠানে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। পাশে কাজ করছেন তার ভাই, প্রতিবেশীরাসহ আরো কয়েকজন। কলমদানি আর ফুলদানি তৈরি করতে বাঁশ ছোট টুকরা করে কাটা হয়েছে। আগুন দিয়ে বাঁশে সেঁক দেওয়া হচ্ছে। সেই বাঁশ ঘেঁষে পরিষ্কার করা হয়। তার ওপরে নানা রঙের ডিজাইন। হাত দিয়ে সব যত্নসহকারে করা হচ্ছে। মাটির ঘরে বেতবোনার মেশিন। পাশে উৎপাদিত টেবিল ল্যাম্প, ফুলদানি, কলমদানি, ওয়ালমেট, ক্যালেন্ডার, দরজা-জানালার পর্দার সারি। বর্তমানে এ কুটির শিল্প পুঁজি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রযুক্তি থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে, যার কারণে উৎপাদনও বেশ কমে গেছে।

শাহ্ জামালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি ৫২টি পণ্য উৎপাদন করে আল্পনা করেন। প্রতিমাসে তার ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প পুরস্কার স্বর্ণপদক পান শাহ জামাল। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও সম্মাননা পেয়েছেন। শাহ্ জামাল জানান, আমার স্বপ্ন ছিল এ শিল্পে বড় অবদান রাখা ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কুমিল্লায় প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাব নেই। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। সময়ের দাবিতে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। পুঁজি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রযুক্তি থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছি। যার কারণে উৎপাদনও বেশ কমে গেছে।

শাহ্ জামাল আরো জানান, বাজারে বাঁশের তৈরি শো-পিসের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। ওইহারে উৎপাদন করার মতো প্রযুক্তি, দক্ষ জনশক্তি ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার জায়গার সঙ্কট আছে। যার কারণে লাভের ভাগীদার হয়ে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। জানা যায়, ১৯৮৬ সালে এসএসসি শেষ করে বাবা বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেমের বড় ছেলে শাহ্ জামাল কুমিল্লা বিসিক থেকে কমার্শিয়াল আর্টের ওপর ৩ বছরের কোর্স শেষ করে বাবার পেশায় পা বাড়ান। আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্পের আওতায় তিনি বুড়িচং উপজেলার বাকশীমুল ইউনিয়ন আনন্দপুর হাজিবাড়ীর পৈতৃক ভিটায় গড়ে তোলেন কুমিল্লা আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস্ নামক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্দেশ্য ছিল কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি তৈরি, প্রশিক্ষণ ও বিক্রয়। প্রথমদিকে বেশ সফল ছিলেন তিনি। ব্র্যাক ও বিসিকের সহায়তায় ৩শ’ নারী ও পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। বিদেশি পর্যটক ও সংস্থাগুলোর আসা-যাওয়া চলছিল নিয়মিত। চীন, জাপান, কলম্বিয়া, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, ইতালি ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিদল সফর করেন শাহ্ জামালের প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কাঁচামালের সঙ্কট নেই, থেমে নেই উৎপাদনও। বিক্রিতেও কখনো ভাটা পড়েনি। কিন্তু বর্তমানের তাল মিলিয়ে নিতে পারছেন না প্রযুক্তির কারণে।

মেশিনারি ও প্লাস্টিকের পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে যান তিনি ও তার সহকর্মীরা। এদিকে তারা নিজেরাও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতো আর্থিক সংগতি অর্জন করতে পারেননি। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ পেশা ছাড়তে শুরু করেন অনেকেই। কুটির শিল্পী মোহাম্মদ শাহ্ জামালকে একজন পরিশ্রমী উদ্যোক্তা হিসেবে চিনে এ অঞ্চলের মানুষ। তার এ কাজকে এগিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন আনন্দপুর গ্রামের মানুষ।

জানা যায়, ১৯৫৫ সালের আগে কুমিল্লা কারাগারে কুটির শিল্পের পণ্য তৈরি হতো। শাহ্ জামালের বাবা বীরমুক্তিযুদ্ধা মরহুম আবুল হাসেম ফটোগ্রাফি করতেন। সেই সময় কুমিল্লা কারাগারে চাকরি করা মহিউদ্দিন নামে একব্যক্তি আবুল হাসেমকে পরামর্শ দেন বাঁশের তৈরি পণ্য তৈরি করার জন্য। ফটোগ্রাফার আবুল হাসেমের আর্টের হাত ভালো ছিল। তিনি মহিউদ্দিনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। নিজগ্রাম আনন্দপুরে এ শিল্পের উৎপাদন শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে এ কাজের প্রসার লাভ করে। বুড়িচংয়ের আনন্দপুর, জঙ্গলবাড়ী, খাড়েরা, ছোট হরিপুর ও ছয়গ্রামের মানুষজন জড়িয়ে পড়েন এ পেশায়। স্বাধীনতা পরবর্তীতে নব্বই দশক পর্যন্ত বেশ দাপুটে অবস্থায় ছিল বাঁশ-বেত শিল্প।

এ বিষয়ে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার বলেন, জীবনমান উন্নয়নে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র কুটির শিল্প উন্নয়নে আমরা বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) বুড়িচং উপজেলাকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) বুড়িচং উপজেলা ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে।

উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. রাসেল সরোয়ার জানান, বুড়িচং উপজেলার মধ্যে আগানগর গ্রামে একটি হস্তশিল্প পল্লী রয়েছে। এ পল্লীতে ৬০ থেকে ৬২টি পরিবার দৈনন্দিন বাঁশ-বেত হস্তশিল্পে কাজ করেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ৩টি সমিতি আমাদের উপজেলা পল্লী উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ ও সহায়তা নিয়েছেন। বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বিগত সময়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা দেওয়া হতো, কিন্তু বর্তমানে আমরা ৩টি সমিতির মাধ্যমে জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়েছি। উপজেলায় আমরা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের একাধিকবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও কৃষি, হাঁস-মুরগি, মৎস্য প্রকল্প নিয়ে যারা কাজ করছে তাদেরও আমরা পরামর্শ ও সহযোগিতা করব।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন কুমিল্লা জেলার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসীর মামুন বলেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বাঁশ-বেত) এর জন্য সরাসরি কোনো প্রকল্প আমাদের হাতে নেই। তবে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাদের মান উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করব। পাশাপাশি ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে ক্ষুদ্র ঋণের জন্য আবেদন করলেও আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। কুটির শিল্পের জন্য আমরা সবসময় কাজ করি। তবে বাঁশ ও বেতের ব্যবহার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য আমরা তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারি। মূলত গ্লোবাল মার্কেটে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজার থেকে ছিটকে পড়েছে এ শিল্পটি। এ শিল্পকে পুনরুদ্দারের জন্য আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close