প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থান গাথা
হেলমেটে হাত বুলালে মনে হয় ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছি
শহীদ রমিজের মায়ের আহাজারি
এ হেলমেটে আমার ছেলের মাথার গন্ধ আছে। এটাতে হাত বুলানোর সময় মনে হয়, আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
রাজধানীর হাজারীবাগের বারোইখালী এলাকার ১৩নং রোডের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এমন কথা জানান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর কারওয়ানবাজার সার্ক ফোয়ারা এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ রমিজ উদ্দিন আহমদের মা রাবেয়া সুলতানা (৪৫)।
রাবেয়া সুলতানা আঁচল দিয়ে টি-টেবিলে থাকা হেলমেট মুছতে মুছতে বলেন, ‘এটি আমার ছেলের। এ হেলমেটে ছেলের মাথার গন্ধ আছে। এটাতে হাত বুলানোর সময় মনে হয় আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
দেওয়ালে ছেলের ছবি পরম আদরে মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘ছেলে কী আর ফিরবে না? চলেই গেল! আন্দোলনে যাওয়ার সময় একটুও বাধা দিইনি ওকে। কেন বাধা দিলাম না, জানি না। বন্ধু প্রান্তকে নিয়ে যাওয়ার সময় শুধু বলল, আম্মু, আমরা আন্দোলনে যাচ্ছি। সেই যে গেল, আর জীবিত ফিরে এলো না।’
শহীদ রমিজ উদ্দিন আহমদ (২১) ড্যাফোডিল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। রমিজ উদ্দিন ২০০৩ সালের ২৪ মে জন্ম গ্রহণ করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে রমিজ ছিলেন ছোট। বড় ছেলে রেদওয়ান আহম্মেদ রঙ্গন (২২) শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী।
রমিজের বাবা এ কে এম রকিবুল আহম্মেদ (৪৮) আগে ব্যবসা করতেন। গত কয়েকমাস হলো তা বন্ধ। শহীদ রমিজের পিতা রকিবুল আহমেদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের ডাকে দেশজুড়ে তখন শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী বিক্ষোভ তুঙ্গে। ছাত্র-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছে রাজধানীর রাস্তায়। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত রাজপথ। তিনি জানান, বাসা থেকে ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে বন্ধু শফিকুল ইসলাম প্রান্তকে নিয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে বেরিয়েছিলেন রমিজ উদ্দিন। যাওয়ার সময় মা রাবেয়া সুলতানাকে বলেছিলেন, আম্মু, আমরা আন্দোলনে যাচ্ছি। ছেলেকে বাধা না দিলেও অজানা আশঙ্কায় ঠিকই কাঁপছিল মায়ের বুক।
বিকেলে শহরের বিভিন্নস্থানে সংঘর্ষ-সহিংসতার খবর শুনে ওর মা ছেলেকে ফোনও করেছিল জানিয়ে রকিবুল আহমেদ বলেন, রমিজ বলেছিল, গ-গোল চলছে, পরে কথা বলছি। কিন্তু কে জানত, সেটাই হবে মায়ের সঙ্গে তার শেষ কথা! বিকেলে কারওয়ান বাজারে পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান রমিজ।
ছাত্র-জনতার বিজয়ে পতন হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। চারদিকে এখন তরুণদের মধ্যে নতুন দেশ গড়ার প্রত্যয়। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও রমিজের অভাব এখনো ভুলতে পারছেন না মা ও বাবা। মোবাইল ফোনে থাকা ছেলের ছবি আর বিভিন্ন স্মৃতি আঁকড়ে এখনো কাঁদছেন তিনি। ঘরের দেওয়ালে থাকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রায়ই বিড়বিড় করে কথা বলেন ছেলের সঙ্গে।
সম্প্রতি বারোইখালি রমিজদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা। দরজা খুলে দেন রমিজের বন্ধু প্রান্ত। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমিজ ও প্রান্ত ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। প্রান্ত থাকেও রমিজদের বাসায়। রমিজের মাকে সে ‘মা’ বলেই ডাকে।
বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্না শুরু করে প্রান্ত। দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলতে পারে না। কিছু সময় পরে জানায়, ৪ আগস্ট রূপ, আকাশ, মাহিনসহ তারা চার বন্ধু একসঙ্গে আন্দোলনে গিয়েছিলেন। তিন বন্ধু বেঁচে ফিরলেও বুলেট বাঁচতে দেয়নি রমিজকে। এটা এখনো কুরে কুরে খাচ্ছে ওর বন্ধুদের।
তিনি বলেন, রমিজের গুলি লাগে ৫টা ১৯ মিনিটে। এর আগে পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করলে আমরাই সবাই যে যার মতো করে দৌড় দিই। পরে ৫টা ১৬ মিনিটে তার সঙ্গে কথা বলে আমরা দেখা করি এবং একসঙ্গে পানি খাই। পানি খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওর চোখে গুলি লাগে এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেখান থেকে পদ্মা ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থা খারাপ দেখে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৬টা ১০ মিনিটে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়া ৪ আগস্ট রাতেই আজিমপুর কবরস্থানে রমিজের লাশ দাফন করা হয়। রমিজের পিতা রকিবুল আহমেদ জানান, মৃত্যুর আগের দিন ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ঘুরে এসে রমিজ হেলমেটটি ওই টেবিলে রেখেছিলেন। এটিতে এখন কাউকে হাত দিতে দেন না তাঁর মা। সরাতেও দেন না।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দুই ছেলের মধ্যে রমিজ ছিল ছোট। বড় ছেলে রেদওয়ান আহমেদ রঙ্গন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। তবে দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব মিল ছিল। তিনি বাসায় না থাকলে রমিজ বড় ভাইয়ের গোসল-খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব কাজ করত। মোটরসাইকেল রমিজের খুব পছন্দ ছিল। আগামী মাসেই নতুন একটি বাইক কেনার কথা ছিল ওর।’ রমিজের বন্ধু প্রান্ত জানান, আমার হাতের ওপরই মৃত্যু হয়েছে রমিজের। ঘটনার দিন একটি ফেসবুক গ্রুপে রমিজ অন্য বন্ধুদের আহ্বান জানিয়েছিল শাহবাগে আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য। তবে গ্রুপের অন্যরা জানান, রাস্তার পরিস্থিতি ভালো না। একসঙ্গে লালবাগ থেকে গেলে রাস্তায় পুলিশ আটকাতে পারে। বরং যে যার মতো শাহবাগে যেতে হবে। এর পরই রমিজ, প্রান্ত, মাহিন ও আকাশ হেঁটে শাহবাগে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন।
তিনি বলেন, দুপুরে শাহবাগ থেকে শিক্ষার্থীদের একটি বড় মিছিল বাংলামটর হয়ে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিল। রমিজসহ তারা চার বন্ধু মিছিলের প্রথমদিকেই ছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে ফার্মগেটে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা চালায়। গুলি ছোড়া হয় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে। পরে শিক্ষার্থীরা পিছু হটে কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা মোড়ে অবস্থান নেন। গুলি লেগে ওর ডান চোখের মনি বের হয়ে গিয়েছিল। ওকে ধরাধরি করে নিয়ে যাই কাঁঠালবাগানের পদ্মা হাসপাতালে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের লোকজন হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেয়। কিন্তু হাসপাতালের স্টাফরা আমাদের তিন তলার একটি কক্ষে লুকিয়ে থাকতে বলেন। প্রায় ১০ মিনিট ঘরে আটকা ছিলাম। পরে রমিজের লাশ নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে করতে প্রান্তও কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘রমিজ আমার শুধু বন্ধু না, ভাই। ভাইকে বাঁচাতে পারলাম না। ওর স্মৃতি ভুলতে পারছি না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সময় গত ৪ আগস্ট রাজধানীর কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শিক্ষার্থী রমিজ উদ্দিন আহমদ। এ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ২২৩ জনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় হত্যা মামলা করে রমিজের বাবা রকিবুল আহমদ।
"