প্রণব দাস, যশোর
যশোরের জগহাটির বাগদি সম্প্রদায়
দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী
‘ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ জীর্ণশীর্ণ কুটিরের ঘিঞ্জি পরিবেশের দারিদ্র্য-ক্লিষ্টতায় ভরা জেলেপাড়ার দুরবস্থার বর্ণনায় এমন উক্তি রয়েছে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে। ওই উপন্যাসে বর্ণিত দুর্দশার মতো সাক্ষাৎ দৃশ্যপট চোখে পড়ে যশোর সদরের চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের জগহাটি বাগদি পল্লীতে।
যশোর-চৌগাছা সড়ক থেকে নেমে কিছু দূর এগোলে জগহাটি বাগদি পল্লী। সেখানে শতাধিক বাগদি পরিবারের বসবাস। সরু অলিগলি ভরা বসতি। জীর্ণ-শীর্ণ ঘরবাড়ি। টিনের চালা ও টিনের বেড়া ফুটোফাটা। এক ঘর থেকে আরেক ঘরের ব্যবধান দু-এক কদম। বলতে গেলে ১০০ ঘর বসতির কারো পৃথক উঠান না থাকায় ঘিঞ্জি অবস্থা।
জরাজীর্ণ টিনের বেড়ায় ঘেরা মাটির মেঝের বসতঘরগুলোর ভাঙাচোরা ও টিনের ফুটোফাটা ঢাকতে চট এবং প্লাস্টিকের বস্তা টাঙিয়ে রেখেছে কোনো কোনো পরিবার। পাড়াটি ঘুরে দেখা যায়, এখানকার ছেলেরা দিনের বেশির ভাগ সময় মার্বেল খেলে সময় কাটায়। শিশুদের বেশির ভাগই স্কুলে যায় না।
দেখা গেছে, গরু-ছাগলের গোয়াল ঘর ও মানুষের বসতঘর একদম পাশাপাশি। যাদের ঘরের বারান্দা নেই তারা জায়গার অভাবে ঘরের ভেতরে রান্না করেন। কারো কারো গোয়ালঘর ও রান্নাঘর এক হয়ে গেছে। দুই ঘরের হাতখানেক ব্যবধানের মধ্যখানে টিউবওয়েল পোতা। সেখানেই চলে থালাবাসন ধোয়া থেকে শুরু করে গোসল ও হাতমুখ ধোয়া।
স্যানিটেশনের দিক থেকেই পিছিয়ে পল্লীটি। শৌচকর্মের জন্য আধুনিক কোনো ল্যাট্রিন পর্যন্ত নেই। পাড়ার মধ্যে মাটির রাস্তাটি বর্ষাকালে কাদায় সয়লাব থাকায় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়া যায় না। এমনটি বলছিলেন এখানকার বাসিন্দা চন্দনা রানি।
একসময় এখানকার বাগদিদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল জলের শস্য মৎস্য আহরণের পাশাপাশি কাঁকড়া ও কুঁচে ধরা। কিন্তু জগহাটি বাঁওড় পাড়ের বাগদিদের সেই জীবন উপাখ্যান বদলে গেছে। জগহাটি বাঁওড়সহ স্থানীয় কোনো উন্মুক্ত জলাশয়ে নামতে দেওয়া হয় না তাদের। ফলে বংশানুক্রমিক পেশা বদলে দিনমজুর ও কৃষি শ্রমিক হিসেবে সংসারের জোয়াল টানতে বাধ্য হচ্ছে বাগদি সম্প্রদায়।
চন্দনা রানি ও রতনা পাড়ৈ নামে বাগদি পাড়ার দুই গৃহবধূ জানান, জলাশয় থেকে মাছ ধরে বিক্রি করা তাদের পেশা। কিন্তু জগহাটি বাঁওড়ে তাদের নামতে দেওয়া হয় না। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দল বাঁওড়টি দখল করে নেন। হরি পাড়ৈ নামে বাগদি পাড়ার আরেক বাসিন্দা বলেন, বাঁওড়ে এখন আমরা নামতে পারি না। এই বাঁওড়টি আগে আমাদের ছিল। এ নিয়ে মামলা চলছে। প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় তালিকাভুক্ত মৎস্যজীবী হওয়ার পরও বাঁওড়ে তারা মাছ ধরতে পারেন না বাগদিপাড়ার বাসিন্দারা। অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাধারেও নামতে বাধা দেওয়া হয়। ফলে দিনমজুরিসহ অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছেন জগহাটির বাগদিরা।
২০২৩ সালে প্রেস ক্লাব যশোরের সামনে বাঁওড় দখলদার মুক্তের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন বাগদি সম্প্রাদায়ের মানুষ। প্রকৃত মৎস্যজীবীরা যাতে বাঁওড়ে তাদের অধিকার ফিরে পান; প্রশাসনের কাছে মানববন্ধন থেকে দাবি জানানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
বাগদিপাড়ার বাসিন্দারা জানান, এখানে হাতে গোনা যে কয়েকটি নলকূপ রয়েছে এর পানি পানের উপযোগী নয়। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি বয়ে আনতে হয়। টয়লেটের অবস্থাও খুবই খারাপ। ১০০টি পরিবারের ব্যবহারের জন্য ৫টি অস্বাস্থ্যকর টয়লেট রয়েছে।
তারা আরো জানান, শ্মশানে যাওয়ার কোনো রাস্তা না থাকাটা তাদের দুর্ভোগের বড় আরেকটি কারণ। বাঁওড় পাড়ে একটুখানি জায়গা রয়েছে শবদাহের। কিন্তু সেখানে যাওয়ার রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে মরদেহের সৎকারের জন্য শ্মশানে যেতে সমস্যা হচ্ছে। অন্যের জমির ওপর দিয়ে মরদেহ নিয়ে শ্মশানে যেতে বাধা দেওয়া হয়।
এ পাড়ার প্রবীণ ব্যক্তি শিরীষ তরফদার জানান, ২০ থেকে ২৫ বছর আগেও তারা জগহাটি বাঁওড় থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন অন্যের মাছ ধরার শ্রমিক হিসেবে বাঁওড়ে নামতে হয়।
বাগদি সম্প্রদায়ের নারীরা বলেন, আগে বাঁওড় থেকে মাছ ধরে আনতেন তাদের বাড়ির পুরুষরা। সেই মাছ বিক্রি করে সংসার চলত তাদের। বাঁওড়টি এখন প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় তারা সেখান থেকে মাছ ধরতে পারেন না। মাছ কিনে এনে বিক্রি করে সংসার চালাতে হয় এখন।
তারা জানান, সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। অনেকগুলো টিউবয়েল থাকলেও প্রচুর পরিমাণে আয়রনের কারণে পান করার উপযোগী না। অনেক দূর হেঁটে খাবার পানি আনতে যেতে হয়। এ ছাড়া কাঁচা রাস্তার কারণে বর্ষাকালে স্কুলে যেতে সমস্যা হয় শিক্ষার্থীদের। পানি কাদায় সয়লাব রাস্তা দিয়ে চলাচলে অনেক সমস্যা হয়।
রত্না পাড়ৈ ও ববিতা পাড়ৈ নামে দুই গৃহবধূ জানান, আয়রন বেশি হওয়ায় অনেক দূর থেকে খাবার পানি বয়ে আনতে হয়। এখানকার বাসিন্দা কেশবতী রানির বয়স আশির কাছাকাছি। তিনি জানান, কতবার ভোট দিলাম। কতজন ভোটে জিতে চেয়ারম্যান ও মেম্বার হলো। এখন পর্যন্ত কোনো বয়স্ক বা বিধবা ভাতা পেলাম না।
শোষণ ও বৈষম্যের শিকার বাগিদপাড়ার মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো ধরনের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে কি না এমন প্রশ্নে যশোর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, সেখানকার বাসিন্দারা তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে সেগুলো সমাধানের জন্য একটি আবেদন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাগদি সম্প্রদায়কে বাঁওড়ে নামতে দেন না- এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেবেন। এরকমটি হলে সমাধানে উদ্যোগী হবেন।
"