প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থান গাথা
জোগাড় হলো না বাজারের টাকা, লাশ হয়ে ফিরলেন তুহিন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কারফিউর কারণে রোজগার বন্ধ। অসুস্থ বাবা বিছানায়। ঘরে পরের দিনের বাজার করার টাকাও নেই। এ অবস্থায় গত ২০ জুলাই বিকালে অটোচালক মো. তুহিন মিয়া বাজার করার টাকা জোগাড় করতে অটোর খ্যাপ নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তার আর বাজারের টাকা রোজগার করা হলো না। উল্টো রক্তাক্ত লাশ হয়ে ঘরে ফিরলেন তুহিন মিয়া (১৮)।
শহীদ তুহিন মিয়ার মা তাসলিমা বেগম (৩২) বলেন, ‘অভাবের সংসারে আমার তুহিন সবাইকে আগলে রেখেছিল। তার বাবা অসুস্থ থাকায় সে অটো চালাত। ২০ জুলাই বিকেল ৫টায় আমার ছেলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। ছেলে বলেছিল মা কালকে বাজার করার টাকাটা রোজগার হলেই চলে আসব। আমার ছেলে তো আর ফিরল না। আমার ছেলের কী অপরাধ ছিল? কেন আমার ছেলেরে গুলি করে হত্যা করল? আমার ছেলে ঘরে আসলেই মা বলে ডাক দিত। বিপদ আপদে আমারে সান্ত¡না দিত। বলত চিন্তা করো না মা আমি তো আছি। ঘরের কেউ অসুস্থ হলে দৌড় দিয়ে ওষুধ নিয়া আসত।
এখন আমারে সান্ত¡না দেবে কে? আমি আমার তুহিন হত্যার বিচার চাই। যারা আমার তুহিনের বিনাদোষে গুলি করে হত্যা করেছে তাদের বিচার দেখে আমি মরতে চাই।’ তুহিন মিয়ার চাচা মো. আবুল হোসেন (৪২) প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বাসসকে জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০ জুলাই বিকেলে গাছা বাজার থেকে অটোতে যাত্রী নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রী নামানোর পর তার ভাতিজা তুহিন মিয়া অটোস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিল দেখছিল। এ সময় বিজিবি সদস্যরা গুলি চালালে একটি গুলি তুহিনের থুঁতনি বরাবর প্রবেশ করে ঘাড়ের পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়।
বিজিবির মুহুর্মুহু গুলির ভয়ে কেউ তুহিনকে তখন উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যেতে সাহস করেনি। ফলে বেশকিছু সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকাবস্থায় তুহিনের ব্যাপক রক্তক্ষরণ ঘটে। বিজিবি চলে যাওয়ার পর লোকজন তাকে গুটিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন গাছা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তুহিন মিয়াকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
গাজীপুর মহানগরীর গাছা ২নং কলোনীর ছোট একটি টিনের ঘরে বাবা, মা, ভাই, ভাবি ও দাদিকে নিয়ে থাকতেন শহীদ তুহিন। এই কলোনির দুই রুমের টিনের ছাপড়া ঘরই তাদের একমাত্র ঠিকানা। তুহিনের বাবা মো. বাবুল মিয়া (৪৬) পেশায় অটোচালক। তবে নানাবিধ রোগব্যাধির কারণে বেশির ভাগ সময় কাজে বের হতে পারেন না। মা তাসলিমা বেগম গৃহিণী ছিলেন। সংসারের প্রয়োজনে অল্প ক’দিন আগে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছেন। বড় ভাই তুষার মিয়া (২৭) কিছুদিন আগে ৫ লাখ টাকা ঋণ করে সৌদি আরব গেছেন। ছোট ভাই হাসান মিয়া (১৩) স্থানীয় গাছা উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
একমাত্র বোন সুমি আক্তারের (২০) বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে। তুহিন অটো চালিয়ে যে আয় করত তা দিয়ে অভাবের সংসারটা কোনোমতে চলত বলে জানান তার একমাত্র চাচা আবুল হোসেন। তুহিনের দাদি ময়ফল বেগম (৭০) বলেন, ‘আমার নাতিডা তো কারো কোনো ক্ষতি করে নাই। দিনভর আমার নাতি অটো চালাইতো। নাতিডায় আমারে ওষুধবড়ি কিনা দিত। আমার এত সুন্দর নাতিরে যে মারছে আল্লাহ তার বিচার করব।’
চার বছরের শিশু ফাতেমা তার চাচ্চুকে এখনো ভুলতে পারছে না। আদরের ভাতিজি ফাতেমার চকলেট, চিপস খাওয়া, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়াসহ সব বায়না ছিল ওর চাচ্চুর কাছে। তুহিন মিয়া সর্বশেষ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ফাতেমা চাচ্চুর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরেছিল। তুহিন মিয়া ভাতিজিকে দোকানে নিয়ে চিপস কিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আরেকদিন আমরা ঘুরতে যাব।’ ফাতেমা তার দাদুকে বলে ‘চাচ্চু তো মরে নাই। চাচ্চু আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে। আমাকে অনেক কিছু কিনে দিবে।’ গাছা বাজারের পরিবহন ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন ভুঁইয়া জানান, তুহিন মিয়া খুব ভালো ছেলে ছিল। কোন রাজনীতি করতো না। পরিশ্রমী ছিল। তার আয় দিয়েই মূলত তাদের সংসারটা চলতো। তুহিনের বাবা বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। মা গৃহিণী ছিলেন। কিন্তু তুহিনের মৃত্যুর পর কয়েকদিন আগে বাধ্য হয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছেন। শহীদ তুহিনের মা তাসলিমা বেগম জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের দুই লাখ টাকা সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
"