শরীফ হোসাইন, ভোলা

  ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ দেলোয়ার

স্ত্রীর সামনে অন্ধকার অবলম্বনহীন মা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২১ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৫)। তার বাবা নেই, মা জিন্নাতুন নেছা (৬৯) এখনো জীবিত। তাদের পাঁচ ছেলের মধ্যে দেলোয়ারই ছিলেন আর্থিকভাবে সচ্ছল। বৃদ্ধ বয়সে ঢাকায় ছেলের কাছেই থাকতেন স্বামীহারা জিন্নাতুন নেছা, পরিণত বয়সে এই ছেলেই ছিল তার অবলম্বন। ছেলেও মায়ের প্রতি দরদী ছিলেন। এদিকে তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বেগম।

দেলোয়ার মারা যাওয়ার ৪ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো কান্না থামেনি মা জিন্নাতুন নেছার। বাড়ির পাশে ছেলের কবরের পাশে ছুটে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। খাওয়া-দাওয়া ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে মায়ের পুরো খরচ চালাতেন ছেলে দেলোয়ার। কিন্তু পুলিশের গুলিতে ছেলে দেলোয়ার নিহত হওয়ায় এখন ভোলায় দিনমজুর ছেলে আনোয়ারের কাছে থাকেন তিনি। অর্থের অভাবে কোনোমতে ৩ বেলা ভাত খেতে পারলেও নিয়মিত ওষুধ খেতে পারেন না।

এদিকে গত ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হলে দেলোয়ারকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তার পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপরও তাকে বাঁচানো যায়নি। ৩ দিন হাসপাতালের আইসিইউতে থেকে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েন। চিকিৎসায় প্রায় ৪ লাখ টাকার বেশি খরচ করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। দেলোয়ার চলে গেলেও পরিবারের কাঁধে তার রেখে যাওয়া প্রায় ৫ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। এটি নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছে নিহত দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বেগম।

নিহত দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বেগম বলেন, তার স্বামী গত ১৯ আগস্ট বিকাল ৪টার দিকে একটি কাজে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে যায়। পরে সেখানকার গোল চত্বরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন। এ অবস্থায় তার তলপেটে পুলিশের ৩টি গুলি লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে একে একে ৩টি হাসপাতালে নিলেও কোথাও কেউ তাকে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার স্বামী দেলোয়ারের। পরে তাকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। ওইদিন রাতেই তার পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু ২১ তারিখ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরে তার মরদেহ ওইদিন সন্ধ্যার পর ভোলা সদরের গ্রামের বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

লিজা আরো বলেন, তার স্বামীর হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ, অপারেশন, মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে ভোলায় আনাসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৪ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। পুরো টাকাই ধারদেনা করে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এখন সেই টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি দেলোয়ারের ফার্নিচারের দোকানটি ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাব্বি হাসান (১৩), ৬ বছরের মেয়ে হাসনুর ও ১৮ মাস বয়সী ছেলে হোসাইনকে নিয়ে চোখে সরষে ফুল দেখছেন।

জামায়াতে ইসলামী থেকে মাত্র ১ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন, আর সরকারি বা বেসরকারি কোনো অনুদান পাননি তিনি। তাই সরকারিভাবে দেলোয়ারের ঋণ পরিশোধ ও সংসার চালানোর মতো ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে দেলোয়ারের মা জিন্নাতুন নেছা বলেন, অনেক সংগ্রাম করে ছেলেদের বড় করেছেন। একটু বড় হওয়ার পর দেলোয়ার ঢাকায় গিয়ে ফার্নিচারের দোকানে কর্মচারীর কাজ নেয়। গত কয়েকবছর আগে মিরপুর-১২ নম্বরে স্টার্ন হাউজিং এলাকায় নিজেই একটি ছোটখাটো ফার্নিচারের দোকান দেয় এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেখানে বাসাভাড়া করে থাকতেন। তিনিও সেখানে থাকতেন।

অন্য ছেলেরা দিনমজুর, জেলে, কাঠমিস্ত্রি ও কৃষি কাজ করেন। দেলোয়ারই তার দেখভাল করতেন। তার শরীরে নানাবিধ রোগে বাসা বেধেছে। ছেলে মারা যাওয়ায় ওষুধ কিনেও খেতে পারছেন না। বৃদ্ধা জিন্নাতুন নেছা তার ছেলের হত্যকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close