গাজী শাহনেওয়াজ
স্পেকট্রাম কেনায় অভ্যন্তরীণ জটিলতার ফাঁদে জিপি
স্পেকট্রাম বা উচ্চগতির নেটওয়ার্ক কেনায় অভ্যন্তরীণ জটিলতার ফাঁদে পড়েছে দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর জিপি (গ্রামীণফোন)। ফলে গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে যে উদ্যোগ নিয়েছিল মোবাইল ফোন অপারেটরটি, তা ভেস্তে যেতে বসেছে। এতে নেটওয়ার্ক দুর্বলতার কারণে গ্রাহকের কথার মাঝখানে যে অনাকাঙ্ক্ষিত কলড্রপ হয়, সেটা থেকেও রেহাই পাবে না জিপি। যদিও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বলছে, অভ্যন্তরীণ ও কৌশলগত কিছু সমস্যা ও জটিলতা রয়েছে, যা উন্মুক্তভাবে বলা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র বলছে, নেপথ্যে জটিলতার মূল কারণ জিপির স্পেকট্রাম চাহিদার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যান্ডউইথ মাত্রা আরো ৮৫০ মেগাহার্জ বাড়ানো। এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা জিপিকে এককভাবে দিলে বাকি অপারেটরগুলোর গ্রাহকসেবায় পদে পদে বাধা পড়ার আশঙ্কাও বেশি। এ কারণে রবি ও বাংলালিংক অভ্যন্তর থেকে কলকাঠি নাড়ছে বলেই সন্দেহ। কেননা যদি গ্রামীণকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাহলে রবি-বাংলালিংকসহ অন্যদের গ্রাহক চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি এরই মধ্যে সরকারি সংস্থা টেলিটককে ২৬০০ মেগাহার্জের ব্যান্ডউইথ দিয়েছে। এখন জিপিকে নতুন করে ব্যান্ডউইথ দেওয়া হলে টেলিটকের টাওয়ারেও নতুন করে ফিল্ডার বসাতে হবে। এটাও খরচ ও সময়সাপেক্ষে ব্যাপার। এ প্রক্রিয়া রবি ও বাংলালিংকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফলে চতুর্থমুখী চাপ ও বাধা পেরিয়ে জিপির নতুন ব্যান্ডউইথ পাওয়া রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে বলে নিশ্চিত করেছে বিটিআরসির নির্ভরযোগ্য সূত্র। তবে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য কিছু ভিন্ন। তারা বলছে, অভ্যন্তরীণ (ইনডোর) কভারেজ বাড়ানোর জন্য লো ব্যান্ড স্পেকট্রাম গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশে ৮৫০ ও ৯০০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম সমানতালে চলছে। গ্রামীণফোন গ্রাহকসেবায় আস্থাশীল। তাই তাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যান্ডউইথ বরাদ্দ সময়ের দাবি। এটার জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সঙ্গে না পাওয়া পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যাবে।
অন্য অপারেটরদের আপত্তি হচ্ছে, গ্রামীণফোন ৮৫০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড থেকে ট্রান্সমিট করলে রবি এবং বাংলালিংকের ৯০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে প্রায় ১০ জিবি পর্যন্ত ইন্টারফেয়ারেন্স তৈরি করবে, যা এ ব্যান্ডে বর্তমানে পরিচালিত টুজি এবং ফোরজি সেবার গুণমানকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে। তবে রবি ও বাংলালিংক তাদের প্রতিটি বিটিএসে এক্সটার্নাল ফিল্টার স্থাপনের মাধ্যমে এ ব্যতিচার রোধ করা সম্ভব বলে তিন অপারেটর সেখানে একমত পোষণ করেছে। তবে রবি ও বাংলালিংক তাদের সমস্যা জানিয়ে বলেছে, পিওসি অনুযায়ী এক্সটার্নাল ফিল্টার ইন্সটলেশনের পর রবি এবং বাংলালিংকের প্রতিটি সাইটের কভারেজ ২ থেকে ৪ শতাংশ কমে যায়। ফলে গ্রামীণ এলাকায় গ্রাহকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং নেটওয়ার্কে ইনডোর কভারেজ কমে যাবে।
গ্রামীণফোনে স্পেকট্রাম বরাদ্দের জন্য রবি এবং বাংলালিংককে ফিল্টার কিনতে বিপুল অর্থ খরচ করতে হবে, যার কোনো সুফল গ্রাহক পাবে না। পাশাপাশি এ ফিল্টারের অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ বেশ জটিল হবে। কভারেজ কমার কারণে রবি ও বাংলালিংক গ্রাহকের নেতিবাচক নেটওয়ার্ক অভিজ্ঞতা হবে এবং নেটওয়ার্ক ট্রাফিকও কমে আসবে। ফিল্টার বসানোর কারণে কভারেজ কমে যাবে আর কভারেজ পূরণ করতে অতিরিক্ত সাইট স্থাপন করতে হবে, যা চ্যালেঞ্জিং ও প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ। এদিকে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) কী রেফারেন্স- আইটিইউ প্রতিবেদন, গাইডেন্স অব রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক ফর ন্যাশনাল স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট অনুযায়ী, নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া স্পেকট্রাম আগের স্পেকট্রামে কোনো ব্যতিচার বা বাধার কারণ হবে না। আর জাতীয় স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনার নীতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ক্ষতিকারক বাধা বা ব্যতিচার হতে আগের সেবাকে নিরাপদ রাখা মূলনীতি।
কত টাকায় জিপিকে এ স্পেকট্রাম : স্পেকট্রাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে গ্রামীণফোনকে ৮৫০ ব্যান্ডে প্রতি মেগাহার্জের জন্য ২৫০ কোটি এবং ৯০০ (ইজিএসএম) ব্যান্ডে প্রতি মেগাহার্জ ২৬৩ কোটি টাকা দিতে হবে। ১৫ বছরের জন্য এ বরাদ্দ পাবে অপারেটরটি। রবির করপোরেট শাখার এক কর্মকর্তা জানান, এসএমপি অপারেটর গ্রামীণফোন তার কভারেজের সমস্যা দূর করার জন্য এমন একটি ব্যান্ড চাচ্ছে (৮৫০ মেগাহার্টজ) যাতে অন্য ছোট অপারেটরদের নেটওয়ার্ক এবং গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রামীণফোনকে ৮৫০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড থেকে স্পেকট্রাম দেওয়া হলে রবির প্রায় ১৮ হাজার সাইটে এক্সটার্নাল ফিল্টার ইনস্টল করতে হবে, যা রবির কভারেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তিনি বলেন, এতে লো ব্যান্ডগুলোর স্পেকট্রাম সব অপারেটরেরই প্রয়োজন। তাই বিটিআরসির স্পেকট্রাম রোডম্যাপ প্রণয়নের সময় সব লো ব্যান্ড স্পেকট্রাম একত্রে উন্মুক্ত করা- যাতে অপারেটরগুলোর মধ্যে লো ব্যান্ডের স্পেকট্রামে ভারসাম্য সমুন্নত থাকে। একই সঙ্গে একে-অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী স্পেকট্রাম অধিগ্রহণ করতে পারে।
বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের বক্তব্যেও অভিন্ন। তারা বলছেন, বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ইজিএসএম ৯০০ ব্যান্ডের (ব্যান্ড-৮) সঙ্গে বাংলাদেশে একযোগে ব্যবহার করার জন্য ৮৫০ ব্যান্ড (ব্যান্ড-৫) বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে বিটিআরসির সিদ্ধান্ত যুগোপযোগী। এ দুটি ব্যান্ডের সম্ভাব্য সংঘর্ষ (ইন্টারফেয়ারেন্স) মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘গ্রুপ অব কনসেপ্ট’ (পিওসি) পরিচালনায় বিটিআরসির উদ্যোগ প্রশংসাজনক।
"