নিজস্ব প্রতিবেদক ও রামগতি-কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি
লাখ টাকা ঋণের প্রলোভনে শাহবাগে লোক জড়ো করার চেষ্টা
লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকামুখী শতাধিক নারী-পুরুষ আটক
১ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা করে ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে রাজধানীর শাহবাগে জনসমাগমের চেষ্টা করেছে একটি সংগঠন। প্রলোভনে পড়া লোকজন ও শাহবাগ থানা-পুলিশ এ তথ্য জানিয়েছে। এদিকে এ প্রলোভনে পড়ে ঢাকা আসার সময় শতাধিক নারী-পুরুষসহ ৪টি মাইক্রোবাস, ৫টি বড় বাস আটক করেন স্থানীয়রা। পরে পুলিশ এসে ৮৫ জনকে থানায় নিয়ে যায়।
প্রলোভনে পড়া লোকজন বলছেন, ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। শাহবাগে যারা উপস্থিত হবেন, তাদের ১ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে। পুলিশ ও শাহবাগে আসা লোকজন বলছেন, এমন প্রলোভনে পড়ে গত রবিবার রাত ১টার পর সারা দেশ থেকে বাস, পিকআপ ও মাইক্রোবাসে সাধারণ মানুষ ঢাকায় আসতে শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসা লোকজনকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন।
গতকাল সোমবার সকাল ৭টায় শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচণ্ড যানজট দেখা যায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পুলিশ আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন। পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। বাসে আসা বেশকিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই জানেন না, শাহবাগে ঠিক কী হবে। তারা বলেন, তাদের ১ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে- এমন কথা বলা হয়েছে। এজন্যই তারা এসেছেন। কয়েকজন ব্যক্তির ভাষ্য, তাদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ১ হাজার করে টাকা নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি শাহাবুদ্দিন শাহিন বলেন, ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন শাহবাগে অনেক মানুষ জমায়েত করার জন্য অনুমতি চেয়েছিল। পুলিশ অনুমতি দেয়নি। সংগঠনটি গ্রামের লোকজনকে প্রলোভন দিয়েছিল, যারা এ সমাবেশে আসবেন, তাদের ১ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হবে। পুলিশ লোকজনকে জড়ো হতে দেয়নি।
লক্ষ্মীপুরে শতাধিক নারী-পুরুষ আটক : ঢাকায় সমাবেশে যোগ দিলেই মিলবে সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ- এমন প্রলোভনে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল গ্রামের শত শত নিরীহ নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরীকে। রবিবার রাতে কথিত সেই সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকায় যাত্রাকালে লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগরে ৩ শতাধিক নারী-পুরুষ স্থানীয় জনতা ও পুলিশের হাতে আটক হন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে কমলনগর থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল। পরে পুলিশ ৪টি মাইক্রোবাস, ৫টি বড় বাসসহ ৮৫ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
আটক বাসগুলো হলো- ঢাকা মেট্রো-ব ঢাকা এক্সপ্রেস ১৩-৩২৭৮, সোবহান আল্লাহ ১৪-৭৭০৮, শাহী এক্সপ্রেস ১৫-৮১৭৯, মাইক্রোবাস ১২-০৭৩২, ১২-৩৪৭৪, ১২-৩৬০৬ ও ১৩-৮৭৭৫। ভাড়া করা যাত্রীবাহী বাস ঢাকা এক্সপ্রেসের চালক মো. সোহেল জানান, আলমগীর ও সিরাজ নামে দুই ব্যক্তি ঢাকায় যেতে তাদের বাস ভাড়া করেছিলেন। কিন্তু তারা গাড়ি থেকে সটকে পড়েন। আলেয়া নামের এক নারী জানান, আজ (গতকাল) ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা শাহবাগের একটি সমাবেশে যোগ দিতে লোকজন নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেখানে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তারা প্রস্তাব দেবেন। ওই টাকা থেকে তাদের মতো গ্রামের নারী-পুরুষদের ১ লাখ থেকে বড় অঙ্কের টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে বলে জানান ওই নারী।
স্থানীয় মোরশেদ আলম নামে এক যুবক জানান, ৫ আগস্টের কয়েকদিন পর থেকে একটি চক্র গ্রামের মানুষদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার নাম করে সংগঠিত করছিল। রবিবার রাতে সেই চক্রের আহ্বানে শত শত নারী পুরুষ ঢাকায় ছুটে যাচ্ছিলেন। উত্তর চরলরেঞ্চ গ্রামের গৃহবধূ ফারহানা আক্তার জানান, তিনি ১০ টাকার বিনিময়ে ১ লাখ টাকা ঋণ পাবেন। তবে এজন্য তাকে ঢাকার সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। সমাবেশে যোগ দেওয়ার পরের দিন থেকে তাদের কে ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। তোরাবগঞ্জ গ্রামের গৃহবধূ জেসমিন আক্তার জানান, গাড়ি ভাড়া হিসেবে তিনি ১ হাজার টাকা দিয়েছেন। তার মতো এরকম প্রায় ১ হাজার লোক থেকে টাকা নিয়েছে স্থানীয় সংগঠকরা।
বাসযাত্রী নারী পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি চক্র গতকাল সোমবার ঢাকার শাহবাগ কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হতে তাদের উদ্বুদ্ধ করে। ঋণের আবেদন ও সম্মেলনে উপস্থিতির জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে তারা নিয়েছে ১ হাজার টাকা। ঋণপ্রত্যাশী ও সম্মেলনে উপস্থিতির জন্য দেওয়া হয়েছে টোকেন। টোকেনধারী সবাইকে দেওয়া হবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে ১ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ। তবে স্থানীয়রা জানান, লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে আরো বিপুলসংখ্যক গ্রামের নারী-পুরুষ ঢাকা অভিমুখে ছুটে গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, স্থানীয় থানায় ৪টি মাইক্রোবাস, ৫টি বড় বাস আটক করে পুলিশ। প্রতিটি গাড়িতে নারী-পুরুষ ছিল। কোথায় যাচ্ছে, জানতে চাইলে গাড়িতে আটক থাকা ফরিদা বেগম জানান, তার বাড়ি চর মার্টিন। সবাইকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন তিনি। সেখানে একটা সভা হবে, এ লক্ষ্যে ফর্ম পূরণ করেছেন তিনি। সভা সফল হলে ১ লাখ টাকা করে ঋণ পাবেন তারা। তিনি আরো জানান, ‘উম্মে হানি নামে এক নারী তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। গাড়িতে জনপ্রতি ভাড়া ১ হাজার টাকা করে নিয়েছে। এ সময় গাড়িতে থাকা নারী-পুরুষগুলো বেশিরভাগই বয়স্ক-বৃদ্ধ দেখা যায়।
রাশেদ নামে আরেক ব্যক্তি জানান, ১ লাখ টাকা লোন দেবে, তাই ঢাকা যাচ্ছেন তারা। তার বাড়ি তোরাবগঞ্জের ৮নং ওয়ার্ড। অন্যরা জানান, তারা সবাই ঢাকা যাচ্ছে, সংস্থা কিস্তি দেব, ফরম পূরণ করেছে। আটক মো. শাহাবুদ্দিন জানান, দেড় মাস আগে তিনি ফরম পূরণ করেন, ঢাকা গিয়ে আন্দোলন করলে সরকার তাদের ১ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেবে। তিনি মিজান নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ২টি মাইক্রোবাসে নারী-পুরুষ নিয়ে ঢাকায় রওনা হন। পরে স্থানীয়রা তাদের আটক করে পুলিশে দেন।
উপজেলার করইতোলা বাজার ব্যবসায়ী ও সাধারণ সম্পাদক মো. নুর আলম মোরশেদ জানান, হঠাৎ খবর পেলাম কিছু লোক গাড়ি করে ঢাকায় যাচ্ছে। তখন বাজারে দেখি দুটি গাড়ি (ঢাকা এক্সপ্রেস, বৈশাখী), দুটি মাইক্রোবাসে প্রায় ১০০-১৫০ জন লোক রয়েছে। তাদের আটক করে জানতে চাইলে তারা জানান, কে বা কারা তাদের দিয়ে ফরম পূরণ করিয়েছে যে, ঢাকা গিয়ে আন্দোলন করলে ১ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে, কোনো কিস্তি বা সুদ নেবে না। তারা সবাই খেটে খাওয়া সাধারণ লোক। পরে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী এসে তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যান।
স্থানীয়রা জানান, কিছু সরকার বিরোধী প্রতারক চক্র রাতের আধারে লুকিয়ে লুকিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। যাদের ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে এদের নেওয়া হচ্ছে। জনতার হাতে প্রায় ৩ শতাধিক নারী-পুরুষ গাড়ি, মাইক্রোবাসসহ আটক হয়েছে। এদের বেশিরভাগই বয়স্ক, বৃদ্ধ, খেটে-খাওয়া সাধারণ শ্রমিক-কৃষক-দিনমজুর মানুষ রয়েছে।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮৫ জনকে থানায় আনা হয়েছে। তাদের ঋণ দেওয়ার কথা বলে ঢাকায় নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গ্রামের মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে ঢাকায় নেওয়ার মূল হোতাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ‘অহিংস আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ঢাকায় সমাবেশ করার জন্য তাদের জড়ো করা হচ্ছিল। ঢাকায় সমাবেশের নামে মূলত সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন।
"