বেনাপোল-মনিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি

  ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

শার্শায় ৫০০ একর জমি অনাবাদির আশঙ্কা

মনিরামপুরে ধান উৎপাদনে বিপর্যয়

যশোরের শার্শার দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি বিল ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে থাকায় ৫০০ একর জমি আনাবাদি থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে ভবদহের জলাবদ্ধতায় মনিরামপুরে চলতি আমন মৌসুমে ধান উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

যশোরের শার্শা উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের মাখলা, ঠেঙামারী ও গোমর বিলে এখনো ১০ ফুট পানি। ফলে ইরি বোরো ধানের চাষ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষিরা। জলাবদ্ধতায় সাড়ে ৫০০ একর জমি আনাবাদি থাকার আশঙ্কা কৃষিবিভাগের। আষাঢ় মাসের শুরু থেকে এ বছরে একটানা ভারী বর্ষণে এলাকার ছোট-বড় ও মাঝারি সব বিল তলিয়ে যায়। এখন অগ্রহায়ণ মাস। পানিতে টইটম্বুর উপজেলার অধিকাংশ বিল। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এই অবস্থা।

রুদ্রপুর গ্রামের আজিজুল অভিযোগ করেন, ১৯৭০ সালের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নির্ধারণী ইছামতী নদী নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। আর সেই থেকেই কপাল পুড়েছে এ অঞ্চলের চাষিদের। বিলের পানি আগের মতো আর নিষ্কাশিত হতে পারে না। উপরন্তু নদীর উজানের পানি উপজেলার রুদ্রপুর-দাউদখালী খাল দিয়ে মাখলা ও সোনামুখি বিলে প্রবেশ করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। ছয় মাস ধরে বিল তলিয়ে থাকে। এর সমাধানের জন্য ৮০-এর দশকে রুদ্রপুর-দাউদখালী খালের ওপর তিন ব্যান্ডের একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এতেও উজানের পানি রোধ করা যায়নি। এরপর ৯০ দশকে ২০ গজ দূরত্বে আরো একটি পাঁচ স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। এতে নির্মাণকাজে ত্রুটি থাকায় আগের মতোই উজানের পানি প্রবেশ করে মাঠ তলিয়ে যেতে থাকে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে দাউদখালী খালের প্রবেশমুখে বাঁধ দিয়ে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে পানি সেচে ঠেঙামারী বিলে ধান রোপণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এ বছর পানির চাপ অনেক বেশি থাকায় ও অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় সেটিও সম্ভব হবে না বলে স্থানীয়রা মনে করেন।

রুদ্রপুর গ্রামের চাষি সিরাজুল ইসলাম জানান, ঠেঙামারী বিলে এখনো ৮ থেকে ১০ ফুট পানি রয়েছে। যে কারণে চলতি মৌসুমে ধান চাষ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

বাগআঁচড়া ইউনিয়নের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, প্রতি বছর দক্ষিণ শার্শা মাখলার বিলে ৪০০ একর, ঠেঙামারী বিলে ৫০০ একর ও গোমর বিলে ২০০ একর জমিতে ইরি বোরো ধানের চাষ হয়। এবার বিলে জলাবদ্ধতার কারণে চলতি মৌসুমে মাখলা বিলে ২০০ একর, ঠেঙামারী বিলে ২৫০ একর ও গোমর বিলে ১০০ একর জমি পতিত থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পানি নিষ্কাশিত হলে প্রায় সব জমিতে ইরি চাষ করা সম্ভব।

আনিছুর বলেন, আমরা পানি নিষ্কাশনের জন্য গোমর বিলের মাঝখান দিয়ে খাল কেটে কলারোয়ার সোনাই নদীতে সংযোগ করার জন্য নকশা সহকারে সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বিলের পানি সোনাই নদী দিয়ে ভারতের ইছামতী নদীতে ফেললেই জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে।

রুদ্রপুর গ্রামের কৃষক নায়েব আলী কাজী বলেন, এককালে এই এলাকায় যারা ধনী চাষি পরিবার ছিল, আজ তারা অসহায়। ঠেঙামারী বিলসহ আশপাশের আওয়ালী বিল ও গোমর বিলসহ বেশ কয়েকটি বিল আষাঢ় মাস থেকে পানির নিচে ডুবে আছে। এর ফলে রুদ্রপুর, দাউদখালী, ভবানীপুর, কায়বা, পাঁচকায়বা, গাজীর কায়বা, পাড়ের কায়বা ও বাইকোলাসহ কায়বা ইউনিয়নের ৮ গ্রামের হাজার হাজার চাষি আমন ধানের চাষ করতে না পেরে পথের ফকির হয়ে গেছেন।

দাউদখালী গ্রামের আকবর হোসেন বলেন, আমাদের পরিবারের সবাই কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। লাভ-লোকসান যেটাই হোক কৃষি কাজ করে চলতে হয়। এবার হঠাৎ অতি বৃষ্টির কারণে আমাদের সবকিছুই ডুবে যায়। বিলের পানি না সরলে ইরি ধানেও আমাদের মার খেতে হবে।

টেংরা গ্রামের শামীম আহমেদ বলেন, আমাদের অধিকাংশ জমি মাখলার বিলে। অতিবৃষ্টিতে আমাদের আমনের স্বপ্ন বৃষ্টির পানির নিচে চাপা পড়ে। আগাম চিন্তা করছি ইরি ফসল নিয়ে, অনেক স্বপ্নও দেখছি। ফসল উঠে পাওনাদারের দেনা পরিশোধ করব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিল এখনো পানিতে পরিপূর্ণ।

শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপক কুমার সাহা বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও আমি বিলের মাঠ পরিদর্শন করেছি। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অবহিত করা হয়েছে। কত একর জমি অনাবাদি থাকবে জানতে চাইলে দীপক কুমার বলেন, এখনি তো বলা সম্ভব হবে না।

ভবদহের জলাবদ্ধতায় আমন ধান উৎপাদনে বিপর্যয় : ভবদহের জলাবদ্ধতায় চলতি আমন মৌসুমে ধান উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। শুধু চলতি আমন মৌসুম নয়; এবার বোরো মৌসুমেও গেলো বছরের তুলনায় ধান উৎপাদনে ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসের তথ্যমতে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যশোরের মনিরামপুরে প্রায় ২৫ হাজার টন ধান কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে, মাঠ পর্যায়ের চিত্রে ধান উৎপাদন আরো কমবে বলে কৃষকরা মনে করছেন।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও ২২ হাজার ৬৪৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। এতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৩০ টন। যা গেল বছরের তুলনায় ২৪৫ হেক্টর বেশি জমিতে ধান চাষ হয়। কিন্তু চলতি আমন মৌসুমে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ভবদহের জলাবদ্ধায় উপজেলার ৬ ইউনিয়নে আমনখেত পানিতে তলিয়ে যায়। এতে ৪ হাজার ৪৬৭ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। প্রতি হেক্টর জমিতে ধানের উৎপাদন ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ১ টন। প্রতি ২০ বর্গফুট ধান কেটে ঝাড়াই করার পর ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা বাদ দিয়ে ধান উৎপাদন হয়েছে ৫ দশমিক ১ টন। সেই হিসাবে এবার ২১ হাজার ২২২ টন ধান উৎপাদন হচ্ছে না।

তবে, মাঠ পর্যায়ে ধান উৎপাদন আরো কমবে বলে কৃষক আশঙ্কা করছেন। উপজেলার কুলটিয়া, হরিদাসকাটি, ঢাকুরিয়া, মনোহরপুর, শ্যামকুড় ও নেহালপুর ইউনিয়নের আমন ক্ষেত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কার্তিক মন্ডল, সুকৃতি বিশ্বাস, নারায়ণ বিশ্বাসসহ একাধিক কৃষক শঙ্কা প্রকাশ করে জানান, আমনের ফলনের মুহূর্তে অতিবৃষ্টির কারণে ধানগাছ মাটিতে নেতিয়ে পড়ে। আবার বিঘার পর বিঘা আমনখেত পানিতে তলিয়ে যায়। যে কারণে তারা পানিতে তলিয়ে থাকা আমনখেত হতে এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারছেন না। শুধু তাই নয়; এবার বোরো মৌসুমে ধান আবাদ নিয়েও চরম সংশয়ে রয়েছেন তারা। এখনো জমিতে পানি রয়েছে। সেক্ষেত্রে বীজতলা তৈরি করার সময় আগত হলেও তারা জমি প্রস্তুত করতে পারছেন না।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার জানান, ভবদহের জলাবদ্ধতার কারণে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের আমনখেত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হরিদাসকাটি ইউনিয়নে ৮৩১ হেক্টর, শ্যামকুড় ইউনিয়নে ৫৭১ হেক্টর, কুলঠিয়া ইউনিয়নে ২৮০ হেক্টর জমিসহ উপজেলায় ৪ হাজার ৪৬৭ হেক্টর জমির আমন ধান নষ্ট হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এবার বোরো মৌসুমেও ধান উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close