নিজস্ব প্রতিবেদক
দুই চাকায় চলে জীবন
‘দেশে তরুণদের জীবিকার জন্য উপার্জনের বিকল্প পথ খুব কম। শুরুর দিকে সারা দিন কাজ করলে মাসে আয় হতো ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। চালকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় আয় কমেছে। ফুলটাইম চালকরা মাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার ও পার্টটাইমারা মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। আর্থিক প্রতিকূলতার ছাড়াও চালকরা প্রতিদিন শারীরিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ে পড়ছেন। সারা দিন বাইরে থাকতে হয়, বাতাসের মান ভালো না। চারদিকে শব্দ দূষণ। প্রচণ্ড গরমে পুড়ে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে’, কথাগুলো বলেন সোয়েব আহমেদ নামে একজন রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার।
শুধু সোয়েব নন, ঢাকা শহরে বেকার অনেক যুবক বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে গিগ অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছেন। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরবাইকচালকের সংখ্যা প্রায় ৪৩ লাখ। রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা। যানজটের সময় চলতে হয় আঁকাবাঁকা সরু গলি ধরে। গাড়ির ধোঁয়া মসৃণ পর্দার মতো ঝুলে থাকে নগরের দিগন্তে। কোটি মানুষের এ শহরে বেশ কয়েক বছর আগে এসেছে এক নতুন পেশা। তারা শহরের বিশৃঙ্খল রাস্তায় মোটরবাইক ও স্মার্টফোনকে কাজে লাগিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন জীবন-জীবিকা। তারা ঢাকার রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার। তাদের গল্প রাজধানীর গিগ অর্থনীতির সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা উভয়ই তুলে ধরে। সোয়েব আহমেদের দিন শুরু হয় সূর্য ওঠার আগেই। এ তরুণ (২৬) একাধারে ছাত্র, অফিসকর্মী ও বাইকচালক।
তিনি বলেন, ‘ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠি। সাড়ে ৬টার মধ্যে রাস্তায়। সকালের যাত্রী নেওয়ার চেষ্টা করি। যানজট শুরুর আগেই ৫০০-৬০০ টাকা আয়ের চেষ্টা থাকে।’ অফিস থেকে পাওয়া ১৪ হাজার টাকায় জীবন চালানো সম্ভব হয় না বলেই রাহাত অন্য অনেকের মতো রাইড শেয়ারিংয়ে ঝোঁকেন। তবে হঠাৎ শুরু করা আয়ের এ পথ ধরেই তিনি পরিবারের খরচ মেটানোর চেষ্টা করছেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। আক্ষেপ করে বলেন, ‘খরচের শেষ নেই। ঘর ভাড়া ৪ হাজার টাকা, খাবার খরচ ৭ হাজার টাকা। কলেজের বার্ষিক ফি ১৪ হাজার টাকার সঙ্গে আছে মোটরসাইকেলের কিস্তি।’ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরবাইক চালকের সংখ্যা প্রায় ৪৩ লাখ। সোয়েবের মতো অনেকে বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে গিগ অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছেন। রাইড শেয়ারিং যখন খুশি, তখন করা যায়। এখান থেকে আয়ে সংসার বা নিজের প্রয়োজন মেটে।
অনেকের কাছে এটি কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ। যা হোক, বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা সত্ত্বেও চালকদের জীবনে অনিশ্চয়তা আছে। ‘সরকারি চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি। ততদিন পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যাব।’ অর্থনৈতিক চাপ সামলাতে তরুণদের পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার এক সাধারণ ঘটনা এটি। রাহাত এ করুণ বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে খুব কমই ক্লাসে যেতে পারেন। তিনি বলেন, ‘টাকার প্রয়োজন আগে। তাই ঠিকমতো ক্লাস করতে পারি না। শুধু পরীক্ষা দিই।’ ৪০ বছর বয়সি মাহফুজের মতো চালকদের জন্য রাইড শেয়ারিং ভিন্ন সুযোগ এনে দিয়েছে। মিরপুরে নিজেদের বাড়ি ও নিয়মিত আয় থাকা সত্ত্বেও তিনি রাইড শেয়ারিংকে আয় বাড়ানোর উপায় হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, ‘বাড়তি আয়ের জন্য নিজের গাড়ি দিয়েই এ কাজ করি।’ তবে তমালের মতো তুলনামূলকভাবে সচ্ছল চালকদের জন্য চ্যালেঞ্জও অনেক। তিনি বলেন, ‘পুলিশের চাঁদাবাজি বড় সমস্যা। তবে এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। আমাদের দাবি-অধিকার নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। এটা জরুরি। অনেকে এ কাজে জড়িত।’
হৃদয় হাসান (২৭) জন্য রাইড শেয়ারিংয়ের ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্তটি প্রয়োজনীয়তার কারণেই হয়েছিল। পরিবার তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ায় তাকে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করতে হয়। তিনি বলেন, ‘বাড়তি উপার্জনের জন্য এ কাজ করি। পরিবার পুরোপুরি আমার ওপর নির্ভরশীল।’ তিনি জানান, অনেক সময় দিনে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। ভাগ্য সহায় না হলে ৫০০ টাকা আয় করা অসম্ভব। কারণ এখন চালকের সংখ্যা অনেক। অ্যাপের মাধ্যমে কাজ করলে সাবস্ক্রিপশনের টাকা দিতে হয়। আয় না করলে ঝামেলা। দিন শেষে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় হয়। অ্যাপভিত্তিক সেবায় ভাড়া কম। তাই চুক্তিতে যাত্রী নিলে সুবিধা।’ ‘খেপ মারা’র এ ভাবনা গিগ চালকদের পাঠাও ও উবারের মতো প্ল্যাটফরম পাশ কাটিয়ে চলার আগ্রহকে তুলে ধরছে। এ ধরনের অনেক চালককে শহরের প্রধান রাস্তাগুলোয় দেখা যায়। তারা সম্ভাব্য যাত্রীদের ডেকে বাইকে তোলেন। ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি হয়। রবিন হাসানের মতে, ‘সরকারি নির্দেশনা থাকলেও সেগুলো অনেকটা করপোরেট মালিকবান্ধব।’ তরণদের মধ্যে বেকারত্ব অনেক বেড়ে যাওয়ায় অনেকে আয়ের এ পথ বেছে নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সামগ্রিক বেকারত্বের হার কমলেও মোট বেকারের মধ্যে শিক্ষিতদের সংখ্যা ২০১৩ সালের ৯.৭ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে বেড়ে ২৭.৮ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, স্নাতকধারীরাও দীর্ঘদিন বেকার থাকছেন। কারণ প্রায় ২০ শতাংশ চাকরির জন্য দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়। প্রায় ১৫ শতাংশ চাকরির জন্য দুই বছরেরও বেশি সময় বেকার থাকতে হয়। এ অনিশ্চয়তার সময়ে তরুণদের জীবিকার জন্য উপার্জনের বিকল্প পথ খুব কম। সোয়েব জানান, শুরুর দিকে সারা দিন কাজ করলে মাসে আয় হতো ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। চালকের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় আয় কমেছে। ফুলটাইম চালকরা মাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ও পার্টটাইমারা মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। আর্থিক প্রতিকূলতার ছাড়াও চালকরা প্রতিদিন শারীরিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ে পড়ছেন।
বিআরটিএ জানায়, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে ৪ হাজার ৪৯৪ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৪ হাজার ১৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেঢালা নজরদারি। বিপুলসংখ্যক অবৈধ ও নিম্নমানের যানবাহন রাস্তায় অবাধে চলাচল করছে। গতিসীমাসহ ট্রাফিক আইন মানতে অনীহা সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ। সোয়েব বলেন, ‘রাস্তায় সবচেয়ে বড় ভয় দুর্ঘটনা। সবাই বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়। দুর্ঘটনা ঘটলেও দেখার কেউ নেই।’ অন্তত ১৮ রাইড শেয়ারিং চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি নির্দেশিকা, চিকিৎসা সুবিধা ও বাইক রাখার জায়গা ঠিক করে দেওয়া জরুরি। মজুরি ব্যবস্থা ও চুক্তির বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) সিতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, ‘চালকদের সুবিধার্থে বিদ্যমান নীতিমালার আলোকে চুক্তির নিয়ম ও মজুরি সংশোধনে কাজ করছি। এটি শুধু তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির আওতায় রাইড শেয়ারিং করেন। যারা এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করছেন তাদের জন্য সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারছি না।’ চিকিৎসা সুবিধার বিষয়ে তার মত, ‘যেহেতু এ চালকরা কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী কর্মী নন, তাই তাদের জন্য সব সুবিধা দেওয়া সম্ভব না।’ তিনি মনে করেন, এ মুহূর্তে চালকদের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়।
কমিশন ও যাত্রীদের আয় সম্পর্কে ‘পাঠাও’র সিইও ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘কম কমিশন, পারফরম্যান্সভিত্তিক প্রণোদনা ও অলস সময়কে কার্যকরভাবে ব্যবহারের সক্ষমতার মাধ্যমে আমরা চালকদের সর্বোচ্চ উপার্জনের সুযোগ দিই। আমাদের কমিশন কাঠামো ভালো চালকদের পুরস্কৃত করে। এ হার ১ শতাংশের কম।’ স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে তার দাবি, তারা দেশের প্রথম ও একমাত্র প্ল্যাটফরম, যা ব্যবহারকারী ও যাত্রীকে সুরক্ষা কভারেজ দেয়। এ বিষয়ে উবার ডেইলি স্টারের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। এতসব সংকটের মধ্যে অনেক চালক রাইড শেয়ারিংকে আয়ের সাময়িক উপায় হিসেবে দেখছেন। ‘চালকরা আরো ভালো চাকরি, আরো লেখাপড়া ও আরো নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন’ উল্লেখ করে রাহাত বলেন, ‘এ কাজের ভবিষ্যৎ না থাকলেও আমি এটি করতে পারি কারণ আমি তরুণ। বয়স একটু বাড়লে তা করতে পারব না।’ ইনফোলেডি সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী অনন্য রায়হান বলেন, ‘চালকদের বেশিরভাগই অন্য শহর থেকে ঢাকায় এসেছেন।’ তিনি মনে করেন, ‘এটি অনেকের জন্য বিকল্প কাজের সুযোগ। তবে অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে।’
"