প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১২ নভেম্বর, ২০২৪

গণঅভ্যুত্থান গাথা

অঙ্কুরেই নিভে গেল সম্ভাবনার দীপশিখা

এইচএসসি পরীক্ষার্থী রোহানের স্বপ্ন ছিল সেনা কর্মকর্তা হওয়ার। কিন্তু জুলাইয়ের মাঝামাঝি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় তখন ১৯ জুলাই রোহান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। সেই সঙ্গে স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে যায় তার।

বাবা-মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা এবং পারিবারিক বন্ধনকে উপেক্ষা করে রোহানের মতো অনেক কিশোর-কিশোরী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ফলে তাদের জোরালো এই প্রতিবাদ এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার যৌথ আন্দোলনে রূপ নেয়। যার মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে।

গত ১৯ জুলাই দুপুর আড়াইটায় কাজলায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে পানির বোতল বিতরণ করছিলেন রোহান। এ সময় তার বুকে গুলি লাগে। গুরুতর আহত হন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

১৮ বছর বয়সি রোহান শৈশব থেকেই প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং পরোপকারী ছিলেন। তিনি তার সদাচরণ দিয়ে প্রতিবেশী, বন্ধু, শিক্ষক এবং সতীর্থদের মন জয় করেছিলেন। এ কারণেই রোহানের মৃত্যুর সংবাদে তার ঢাকার এবং চাঁদপুরের প্রতিবেশীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।

রোহানের বাবা মো. সুলতান খান যাত্রাবাড়ীর দনিয়ার গোয়ালবাড়ী মোড় এলাকায় তার বাসার পাশে একটি মুদি দোকান চালান। তিনি বলেন, যখন রোহানের মরদেহ বাসার পাশে বায়তুস সালাম মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সর্বস্তরের মানুষ সেখানে ভিড় জমায় এবং তার প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে।

রোহানের শোকাতুর বাবা বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশীদের শেষবারের মতো দেখানোর জন্যই রোহানের লাশ মসজিদে নিয়েছিলাম। কিন্তু রোহানের সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষকসহ হাজার হাজার মানুষ তাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য মসজিদে ভিড় করে এবং সেখানে তার প্রথম জানাজায় অংশ নেয়।’

মো. রোহান আহমেদ খান ২০২২ সালে একে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে সফলভাবে এসএসসি পাস করার পর দনিয়া কলেজে ভর্তি হন। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সাতটি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে একটি পরীক্ষায় ভালোভাবে অংশ নিতে পারেননি। ফলে এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন তিনি। তবে যেসব পরীক্ষায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে দেখা যায়, তিনি বিজ্ঞান বিভাগের তিনটি বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন এবং বাকি তিনটি বিষয়ে জিপিএ-৪ পেয়েছিলেন।

রোহানের মা মনিরা বেগম জানান, রোহান শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নিত। কিন্তু তারা বিষয়টি জানতেন না। মনিরা বেগম একজন অনানুষ্ঠানিক আরবি শিক্ষক। তিনি তার এক ছাত্রের মায়ের মাধ্যমে প্রথম রোহানের আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানতে পারেন।

তিনি বলেন, ‘প্রথম যেদিন রোহান আন্দোলনে যায় সেদিন সে আমাকে বলেছিল যে সে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। কিন্তু ১৬ জুলাই আমি আমার এক ছাত্রের মায়ের কাছে জানতে পারি, রোহানকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। সে সময় রোহানকে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রথমে সে অস্বীকার করে।

রোহানের মা ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্না ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তবু অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। সে বলে, যখন আমার অনেক ভাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তখন তো আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারি না।’

গত ১৭ জুলাই রোহান আন্দোলনে অংশ নিলে সেদিন তার পায়ে ইটের আঘাত লাগে। এতে তিনি আহত হলে মায়ের কাছে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন এবং পায়ের একটা এক্স-রে করার কথা বলেন।

রোহানের মা ছেলের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি সেদিন পায়ের এক্স-রে করাতে অস্বীকার করে বলি, এক্স-রে করে যদি দেখা যায় কিছু হয়নি তাহলে তুমি আবার আন্দোলনে যাবে। সেদিন আমার কথা শুনে রোহান আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নুডলস খেতে চেয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সে সময় রোহান তার মাকে আন্দোলনে যাওয়ার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। রোহানের শোকাহত মা বলেন, ‘একপর্যায়ে আমি তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করায় সে ১৮ জুলাই আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত থাকে।’

আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধর মৃত্যুতে রোহান অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিল উল্লেখ করে মনিরা বলেন, ‘১৮ জুলাই সন্ধ্যায় রোহান আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল আবু সাঈদ আর মুগ্ধ ভাইকে দেখো। তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই যদি ঘরে বসে থাকি এবং একে অপরকে আন্দোলনে যোগ দিতে বাধা দিই, তাহলে আমরা কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করব?’

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে রোহান আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি রাজাকার?’ এটা শুনে আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।’

তিনি জানান, ১৯ জুলাই শুক্রবার রোহান জুমার নামাজের আজানের আগ পর্যন্ত ঘরের কাজ শেষ করতে তাকে সাহায্য করেন। সেদিন দুপুরের খাবারের জন্য কী রান্না হয়েছে তা জানতে চায়। রোহান বিরিয়ানি খেতে ভালোবাসত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি তাকে বলেছিলাম, আজ আমাকে অনেক কাজ করতে হবে। তাই, বিরিয়ানি রান্না করিনি, তুমি আজ পাবদা মাছ দিয়ে ভাত খাও। তিনি কান্না সংবরণ করতে করতে বলেন ‘আমি আমার ছেলের মৃত্যুর আগে তার প্রিয় খাবার খাওয়াতে পারিনি, এই কষ্ট আমি কী করে ভুলব।’

মনিরা জানান, এরপর রোহান জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যায় এবং বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে আসার পর রোহান তার পাঞ্জাবি খুলে তার কলেজের আইডি কার্ড, মানিব্যাগ, পকেট টিস্যু ও গেটের চাবি নিয়ে দুইটা পাঁচ মিনিটের দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

কান্না দমন করতে করতে তিনি বলেন, বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে, একজন অচেনা লোক আমাকে ফোনে জানায় যে, রোহান গুরুতর আহত এবং আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে যেতে বলে। খবরটি পাওয়ার পর তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং কোনোমতে তার স্বামীকে বিষয়টি জানান।

আন্দোলনে রোহানের একাগ্রতার কথা স্মরণ করে তার মা বলেন, রোহান ১৮ জুলাই প্রায় সারা রাত ‘আমি হব আন্দোলনের চাবি, তোমরা করবে সিংহাসনের দাবি’ স্লোগানটি আবৃত্তি করেছিল।

রোহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার টেবিলে স্কাউটের ইউনিফর্মসহ একটি ছবি এবং বাংলাদেশ স্কাউটসের সম্মাননা স্মারকসহ তার সব বই এবং জিনিসপত্র একইভাবে রাখা আছে। তার টেবিলেই একটি কোরআন শরিফ রাখা। যা তিনি পাঠ করতেন। কোরান শরিফে রোহানের দেওয়া চিহ্নটি দেখিয়ে তার মা বলেন, ‘এখন আমি এই কোরআন তেলাওয়াত করি, কিন্তু আমি আমার ছেলের দেওয়া চিহ্ন সরাইনি। এটা আমার ছেলের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close