প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১১ নভেম্বর, ২০২৪

গণঅভ্যুত্থান গাথা

‘পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে পুলিশ গুলি করে’

জমি-ভিটামাটি বন্ধক রেখে চলছে রিপনের চিকিৎসা

‘চার আগস্ট ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেই। পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলের মুখে টিকতে না পেরে অন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমিও আরপিন গলির ভেতর ঢুকে পড়ি। এ সময় আমি আরপিন নগর ঈদগাহ এলাকায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু বিধিবাম। অটোরিকশার ভেতর থেকে আমাকে টেনে-হেঁচড়ে বের করে পুলিশ। তারপর আমার পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। এরপর আমার কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পাই।’

কথাগুলো বলেন, ২০ বছর বয়সি থাই অ্যালুমিনিয়াম মিস্ত্রি সুনামগঞ্জের রিপন মিয়া। সুনামগঞ্জ শহরতলী বদিপুর মাউজবাড়ি গ্রামে রিপনের বাড়ি গিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য।

দিনটি ছিল ৪ আগস্ট, রবিবার। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সারা দেশের মতো উত্তাল সুনামগঞ্জও। সকাল থেকেই দিনটি ছিল থমথমে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা দখলে নেয়। ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আরো যোগ দেন ২০ বছর বয়সি থাই অ্যালুমিনিয়াম মিস্ত্রি রিপন মিয়াও। এদিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগও ট্রাফিক পয়েন্ট এলাকায় দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। বেলা সাড়ে ১১টায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের একদফা দাবিতে ছাত্র-জনতা শুরু করে বিক্ষোভ মিছিল। মিছিলটি শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে যাওয়ার পথে কামারখাল এলাকায় পৌঁছানোর পর শুরু হয় পুলিশের অ্যাকশন। পুলিশ নির্বিচারে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকে। টিয়ার শেল আর রাবার বুলেটের শব্দে প্রকম্পিত হয় পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকা।

পুলিশের বেপরোয়া টিয়ার শেল আর রাবার বুলেটের মুখে টিকতে না পেরে ছাত্রজনতা পিছু হটতে থাকে। তারা পিছু হটে জেলা সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের কালেক্টরেট এলাকায় অবস্থান নেয়। পুলিশের টিয়ার শেলের ধোঁয়া আর ঝাঁজে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে জেলা কালেক্টরেট এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। ছাত্র-জনতার একটি দল শহরের আরপিন নগর গলির ভেতর ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। এতেও রক্ষা হয়নি ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেওয়া রিপন মিয়ার। আরপিন নগর ঈদগাহ এলাকায় একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশার মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে তাকে বের করে এনে পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করেন সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার তৎকালীন ওসি খালেদ চৌধুরী।

সেদিনের ভয়াবহ ও করুণ চিত্রের বর্ণনা দিয়ে রিপন জানান, গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলের মুখে টিকতে না পেরে অন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তিনিও আরপিন গলির ভেতর ঢোকেন। এ সময় তিনি আরপিন নগর ঈদগাহ এলাকায় একটি সিএনজি চালিত অটো রিকশায় লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু বিধি বাম। অটোরিকশার ভেতর থেকে তাকে টেনে বের করে পুলিশ। তার পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করেন ওসি খালেদ।

রিপন জানান, তার পায়ে ওসি খালেদ গুলি করার পর তিনি মাটিতে গড়াগড়ি করলেও তাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো কেউ এগিয়ে আসেনি, পুলিশের ভয়ে। মাটিতে গড়াগড়ির এক পর্যায়ে তিনি নিজের গায়ের গেঞ্জি খুলে গুলিবিদ্ধ পা বাঁধেন। এরপর আর কিছু মনে নেই। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

পরে শুনেছেন এক রিকশাচালক তাকে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে তার মা আছর বিবি ছুটে যান হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে কর্তব্যরত চিকিৎসক। তিনি জানান, প্রায় ১০ দিন সিলেট ওসমানী মেডিকেলে চিকিৎসার পর তার পায়ে ইনফেকশন দেখা দেয়। পরে তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকায় তৎকালিন শেখ হাসিনা বার্ন এ প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে। সেখানে তার পায়ে অপারেশন হয়। অপারেশনের পর তাকে আবার সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওসমানীতে আরো কিছুদিন ভর্তি থাকার পর কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে তিনি ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই হাসপাতালে তার পায়ে রিং পরানো হয়। রিং পরাতে খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

রিপন জানান, চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা জমি ও বসতঘর এক বছরের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকায় বন্ধক দেন। এছাড়াও বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। স্থানীয় একজন সাংবাদিক বাংলাদেশ হেলথ ইকনোমি নামের সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রিপনের মা আছর বিবি (৪০) জানান, রিপন কেবল পরিবারের বড় ছেলেই না সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিও। তার বাবা বিগত আট বছর ধরে অসুস্থ। কাজকর্ম করতে পারেন না। ছেলে রিপনের ওপর পরিবারের ভরসা।

তাদের তিনটি মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে রোজিনা বেগমের গতবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি। দ্বিতীয় মেয়ে রুবি বেগম পাশর্^বর্তী আমবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে সুমি আক্তার সুনামগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল এ কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়ে। আছর বিবি আরো জানান, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আহত হয়ে পড়ে থাকায় তারা সবাই বিপাকে আছেন। চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। কিভাবে ছেলের চিকিৎসা করাবেন, কীভাবে পরিবার চালাবেন।

রিপনের বাবা কামাল উদ্দিন (৪৫) জানান, তিনি বিগত আট বছর ধরে অসুস্থ। কোন কাজ করতে পারেন না। ছেলেটা কাজ করে সংসার চালাতো। তার রোজগার দিয়ে ঘরটা কোনোভাবে ইটের গাঁথুনি দিয়েছি। ছেলের চিকিৎসা করাতে ঘরসহ বসত ভিটা বন্ধক দেয়া হয়েছে। এক বছরের মধ্যে বন্ধক ছুটাতে হবে। তিনি জানান, রিপনের পায়ে রিং পরানো রয়েছে। তিন মাস পর অপারেশন করে আবার রিং খুলতে হবে। রিপনের চিকিৎসা খরচ বহনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান রিপনের বাবা কামাল উদ্দিন। এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ইসলাম রাজু ও জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম জানান, সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close