জি এম মনিরুজ্জামান, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা)
বনদস্যুদের উৎপাত বেড়েছে সুন্দরবনে
দীর্ঘ স্থিতিশীলতার পর সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে আবারও বেড়েছে বনদস্যুদের উৎপাত। এতে ঝুঁকিতে পড়েছেন বনজীবীরা এবং গভীর উদ্বেগে আছেন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। বনজীবীদের অভিযোগ, দস্যুদের উৎপাত প্রায় কমে গিয়েছিল, সম্প্রতি সাতক্ষীরার পশ্চিম সুন্দরবন এলাকায় আবারও শুরু হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির ঘটনা। সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা জেলেদের ভাষ্য, বনদস্যুরা মৎস্য আহরণে যাওয়া জেলেদের মাছ, টাকা, মোবাইলসহ যা কিছু কাছে আছে সব কেড়ে নিচ্ছে দস্যুরা। চাঁদা না দিয়ে মাছ আহরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দস্যু বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই সাতক্ষীরা ও কালিগঞ্জের বাসিন্দা। তারা তক্তাখালী, চুনকুড়ি, দারগাংসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে বনজীবীদের ওপর হামলা ও জিম্মি করে চাঁদা আদায় করছে।
খুলনার কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের দুই জেলে আতাহার হোসেন (৩৫) ও রফিকুল ইসলাম (৩৮) গত ৮ নভেম্বর সকালবেলায় সাতক্ষীরা রেঞ্জের মালঞ্চ নদীর সাতনলা দুনে এলাকায় অস্ত্রের মুখে জিম্মি হয়ে বনদস্যুদের হাতে অপহৃত হন। জানা গেছে, দস্যুরা মুক্তিপণ হিসেবে ৪ লাখ টাকা দাবি করেছে।
গত ৩০ অক্টোবর, আটজন জেলে চারটি নৌকায় একদল জেলে শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালীনি স্টেশন থেকে অনুমতি সংগ্রহ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ ধরতে যান। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ফিরিঙ্গি এলাকায় মাছ শিকারের পর তারা মালঞ্চ নদীতে পৌঁছান। গত বৃহস্পতিবার রাতে সাতনলা দুনে এলাকায় মাছ ধরার সময় চারজন বনদস্যু অস্ত্র নিয়ে তাদের ঘিরে ধরে। জেলে দলটি জানায়, এই দল দয়াল বাহিনীর নাম ব্যবহার করে তাদের ভয় দেখিয়ে আতাহার ও রফিকুলকে নৌকায় তুলে নেয়।
বেঁচে ফেরা রবিউল ইসলাম ও আছাদুল গাজীসহ অন্যরা জানিয়েছেন, এই দস্যুরা প্রকৃতপক্ষে আত্মসমর্পণ করা মজনু বাহিনীর সদস্য, যারা দয়াল বাহিনীর পরিচয় দিয়ে নতুন করে দস্যুতা চালাচ্ছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রকাশ্যে চারজন সদস্য দেখা গেলেও, দলের প্রকৃত সংখ্যা ৮ থেকে ৯ জনের মতো।
২০১৭ সালে মজনু বাহিনীর প্রধান মজনু তার ১৮ জন সঙ্গীসহ র্যাব-৮ এর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি ছিলেন শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামের বাসিন্দা। আত্মসমর্পণের পর বর্তমানে তিনি খুলনার সোনাডাঙ্গা এলাকায় বসবাস করছেন। তবে সম্প্রতি স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, আত্মসমর্পণ করেও কিছু সদস্য পুরোনো পথে ফিরে গেছে এবং সুন্দরবনে ফিরে গিয়ে দস্যুতায় মত্ত হয়েছে।
বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, জেলেদের পরিবারের কেউ এখনো সরাসরি অপহরণের বিষয়টি তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। তবে সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান জানিয়েছেন, খবর পাওয়ামাত্র দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান চালানো হবে।
এদিকে, সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। গত ৩ নভেম্বর সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদীর তক্তাখালী এলাকা থেকে বনবিভাগের একটি অভিযান চলাকালে ১০ জন অপহৃত জেলেকে উদ্ধার করা হয়। তারও আগে, ৩১ অক্টোবর কাঁকড়া শিকারের সময় শ্যামনগর ও কয়রা উপজেলার দুই জেলে মফিজুর রহমান ও মৃণাল সরদারকে বনদস্যুরা অপহরণ করে।
সুন্দরবনে অপহরণের ঘটনা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বনজীবীসহ সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বনদস্যুদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অব্যাহত থাকতে পারে বলে স্থানীয়রা শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
ভুক্তভোগীদের মতে, আত্মসমর্পণকারী মঞ্জু বাহিনী এবং জেল থেকে পালানো আবদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত আবদুল্লাহ বাহিনীথ আবারও দস্যুতা শুরু করেছে। আবদুল্লাহ বাহিনী সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রামের আবদুল্লাহ তরফদারের নেতৃত্বে গঠিত, যিনি একটি নারী পাচার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। চলতি বছরের আগস্টে কারাগার ভেঙে পালিয়ে তিনি সুন্দরবনে প্রবেশ করেন এবং ফের বাহিনী গড়ে তোলেন। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১০-১২ জন, যাদের অধিকাংশই কারাগার থেকে পালিয়ে আসা অপরাধী।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মঞ্জু বাহিনী ও আবদুল্লাহ বাহিনীর সদস্যদের খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করছে কিছু স্থানীয় সহযোগী। মুন্সীগঞ্জ, হরিনগর ও ভেটখালী বাজার থেকে এসব মালামাল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বনজীবীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম মাসুদুল আলম জানান, বনদস্যুদের নতুন দৌরাত্ম্য আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এ জেড এম হাসানুর রহমান জানান, বনদস্যুদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
"