রংপুর প্রতিনিধি
গণঅভ্যুত্থান গাথা
বুলেট কেড়ে নিয়েছে মমদেলের স্বপ্ন
দুই সন্তানকে ঘিরে ছিল তার ছোট ছোট স্বপ্ন। সন্তানদের শিক্ষিত করবেন, তাদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন। কিন্তু বিধিবাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মমদেল হোসেন এখন পঙ্গু। বাম পা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন (২৯) এ ওয়েল্ডিং শ্রমিক।
তিনি রংপুর মহানগরীর আলমনগর খামার চুড়িপট্টি বস্তির রেললাইনের ধারঘেঁষা একটি ছোট্ট ঘরে তার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জমিলা বেগম (২৪) ও একমাত্র ছেলে জাহিদ হাসানকে (৭) নিয়ে থাকেন।
গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ সমাবেশে ফ্যাসিবাদী শাসকের পুলিশের গুলিতে আহত হন মমদেল। ডাক্তাররা তার জীবন বাঁচাতে একটি পা কেটে ফেলেন। সারা জীবনের জন্যে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হলো মমদেলকে। আর তার পরিবারের ভাগ্যে নেমে এসেছে এক ভয়াবহ অন্ধকার।
সম্প্রতি তাদের বস্তিতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় মমদেল ও তার স্ত্রী জামিলা বেগম তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মমদেল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তার বৃদ্ধ বাবা কবির হোসেন (৭০) হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। মমদেলের মা মনোয়ারা বেগম (৫৫) ও তার বাবা শহরের অদূরে ভুড়ারহাট গ্রামে বসবাস করেন। মনোয়ারা বেগম বিভিন্ন স’মিল ও কাঠের দোকান থেকে কাঠখড়ি এনে বিক্রি করে সামান্য কিছু আয় করেন। তা দিয়ে কোনোমতে চলে তাদের সংসার।
চার ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ মমদেল। তার বড় বোন গৃহবধূ কোহিনূর বেগমের (৩৮) স্বামী হতদরিদ্র সাজু মিয়া একজন শ্রমজীবী। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে তারা অভাব-অনটনের মধ্যে একই বস্তিতে বাস করেন। মমদেলের মেজ বোন লাবনী বেগমের (৩৫) দিনমজুর স্বামী এরশাদ মিয়াও দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে মহানগরীর বাস টার্মিনাল এলাকায় বসবাস করেন। আর মমদেলের বড় ভাই দিনমজুর শের আলী মধু (৩২) তার স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যাসন্তানকে নিয়ে বস্তিতে বাস করেন।
মমদেল ২০১৬ সালে কুড়িগ্রাাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পাটেশ্বরী গ্রামের জামিলা বেগমকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি আলমনগর খামার চুড়িপট্টি বস্তিতে বাস করছেন। এর মাঝে তাদের ছেলে সন্তান জাহিদ হাসানের জন্ম হয়। ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে মমদেল মাসে সাড়ে ১৭ হাজার টাকা বেতন পেতেন। তা দিয়েই চলছিল তাদের সংসার। বর্তমানে তার স্ত্রী জামিলা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পুত্র জাহিদ হাসান তাদের বস্তি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রামীণ উন্নয়ন কেন্দ্র (গাক) নামের একটি এনজিও পরিচালিত শিশু বিকাশ কেন্দ্রে প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।
জুলাই মাসের ওই সময়টা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে উত্তাল ছিল রংপুর। গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর রংপুরসহ দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এক দফার দাবিতে পরিণত হয়। আর আরো উত্তাল হয়ে ওঠে রংপুর। নগরীজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের আক্রমণ, গুলি বর্ষণ, বর্বরতা ও নির্যাতন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
মমদেল বলেন, ‘১৯ জুলাই সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বরাবরের মতো নাশতা হিসেবে ভাত খাই। এরপর হেঁটে হেঁটে এক কিলোমিটার দূরের আমার কর্মস্থল লালবাগ বাজারের চৌকিহাটি এলাকায় নূর মেটাল ওয়ার্কশপে যাই। ওয়ার্কশপ বন্ধ ছিল। আমার স্ত্রী-পুত্র তখন আমার বাবার বাড়ি ভুড়ারহাট গ্রামে ছিল। আমি তখন ওয়ার্কশপ থেকে ভুড়ারহাট গ্রামে যাই। আমার রংপুরের বস্তিতে পানির ব্যবস্থা না থাকায় আমি আমার বাবার বাড়িতে গোসল করি। সেখানে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করার পর খাওয়া-দাওয়া শেষে স্ত্রী-পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে রংপুরের বস্তিতে ফিরে আাসি।’
মমদেল বলেন, ‘সংসারে অভাবের কারণে আমি সবসময় কাজ করার চেষ্টা করতাম। ওই সময় রংপুর স্টেডিয়ামে আগে থেকেই আমাদের ওয়ার্কশপের ওয়েল্ডিং কাজ চলছিল। ওই দিন ওয়ার্কশপ বন্ধ থাকায় আমি কিছু কাজের আশায় রংপুর স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য বিকেল ৩টায় বস্তি থেকে রওনা হই।’ ওখানে গিয়ে দেখি স্টেডিয়ামেও কাজ বন্ধ ছিল। ফলে, আবার বাড়ি ফেরার জন্য হেঁটে রওনা দিই। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় আমি রংপুর সিটি বাজারের কাছে রাজা রামমোহন ক্লাব মার্কেটের সামনে পৌঁছাই।
তখন সেখানে নগরীর প্রধান সড়কে সর্বত্রই বিপুলসংখ্যক মারমুখী পুলিশ ও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে বিক্ষোভকারী হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর ভয়ানক হামলা, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ এবং গুলি বর্ষণ করতে দেখি। সেখানে এক শ্বাসরুদ্ধকর ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রাণে বাঁচার জন্য লোকজন দিকবিদিক ছুটতে থাকে।
মমদেল বলেন, ‘এ সময় আমি ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিছিলকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করছিল। আমি সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য রাজা রামমোহন ক্লাবের বাম পাশের গলি দিয়ে বাজারে ঢোকার চেষ্টা করি। এ সময় আমার কাছ থেকে মাত্র ১০-১৫ ফুট দূরে একজন যুবকের বুকে গুলি লেগে সে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় আমারও বাম হাঁটু এবং বাম হাতে গুলি লাগে। গুলিটি বাম হাঁটু ও বাম হাত ভেদ করে বের হয়ে যায়। তখন আমি প্রাণ বাঁচাতে কোনোরকমে ফল বিক্রির গলির মাথা পর্যন্ত আহত অবস্থায় এগিয়ে যাই। এরপর আর কিছু মনে নেই। রাতে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনতলায় ৩১ নম্বর অর্থোপেডিক্স সার্জারি ওয়ার্ডের একটি বেডে চিকিৎসাধীন।
মমদেলের স্ত্রী জামিলা জানান, মেডিকেল থেকে তখন রাত ৮টায় আমার স্বামীর মোবাইল থেকে কেউ একজন আমাকে কল দিয়ে খবর দেন। আমি হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ডাক্তাররা আমার স্বামীর পায়ে ব্যান্ডেজ করছিলেন। আমার স্বামী তখনো অজ্ঞান ছিল। রাত ৯টায় ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে আমার স্বামীর জ্ঞান ফেরে। এ সময় লোকজন আমার স্বামীর জন্য রক্ত দিয়েছেন। আমাকেও কিছু রক্ত কিনতে হয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট তিন ব্যাগ রক্ত লেগেছে।
পরদিন ২০ জুলাই সন্ধ্যায় ডাক্তার আমার স্বামীকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। ডাক্তার ধারণা করেন যে গুলি লেগে আমার স্বামীর হাঁটুতে থাকা রগগুলো ছিঁড়ে গেছে। আমরা খুব গরিব মানুষ। টাকা পয়সার বড় অভাব। তারপরও ধার করে ১৫ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করাই। তখন ডাক্তার রড দিয়ে খাঁচার মতো বানানো নেট দিয়ে গুলি লাগা হাঁটুর অংশ ঢেকে দেন। এরপর ডাক্তার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে হাঁটুর মাংস সবল আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য আমার স্বামীকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন।
জামিলা বলেন, ‘ওই দিন ২১ জুলাই বিকেল ৪টায় পঙ্গু হাসপাতাল থেকে নিজের টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আমার স্বামীকে নিয়ে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে যাই। সেখানে আমরা তাকে ভর্তি করাই। সন্ধ্যার আগে ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়ে বলেন যে এগুলো দ্রুত নিয়ে আসেন। ওই ওষুধ আনার পরে মাংস পরীক্ষা করা হবে। এ সময় ওষুধ নিতে আমার সঙ্গে যাওয়া আমার স্বামীর দুই মামা খোকন এবং নাজমুলসহ আমি গেট থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠি। সেখানে থাকা পুলিশ আমাদের জিজ্ঞাসা করে কীসের রোগী, কোথা থেকে নিয়ে এসেছেন ইত্যাদি। আমি মিথ্যা কথা বলি যে আমার স্বামী সিএনজি অ্যাক্সিডেন্টের রোগী।
তখন পুলিশ জোর করে কাগজগুলো হাতে নিয়ে বলে এই রোগী তো গুলিবিদ্ধ। আমাদের আটকে দেয়। ওষুধ কেনার জন্য আর যেতে পারলাম না। এ সময় পুলিশের আগ্রাসী ভাব দেখে ভয়ে আমাদের দুই মামা সেখান থেকে পালিয়ে যান। কোনো উপায় না দেখে আমি ওষুধ ছাড়াই আবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ফিরে আসি। ডাক্তারকে বিষয়টা জানালাম। তিনি বললেন, এসব ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
জামিলা বলেন, আবারো ১৫ হাজার ৬০০ টাকায় একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করি। আমার স্বামীকে নিয়ে রংপুর রওনা দিই। আমরা সেখান থেকে পালিয়ে আসায় টেস্ট রিপোর্ট ও অন্য কাগজপত্র পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে থেকে যায়। আমরা সঙ্গে আনতে পারিনি। পরদিন ২২ জুলাই ফজরের আজানের সময় আমরা রংপুর পৌঁছাই। এরপর রংপুর হেলথ সিটি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশে অবস্থিত ডক্টরস কমিউনিটি হাসপাতালে আমার স্বামীকে ভর্তি করাই। এখানেও ভর্তির সময় মিথ্যা কথা বলি যে আমার স্বামী সিএনজি এক্সিডেন্টের রোগী। কারণ গুলি লাগার কথা শুনলে পুলিশি ঝামেলার ভয়ে ভর্তি করবে না।
এই হাসপাতালে ডাক্তাররা পায়ের মাংস ঠিক করার জন্য তিন দিন আমার স্বামীর চিকিৎসা করেন। এতে করেও পায়ের মাংস বা মাংসপেশিতে কোনো অনুভূতি সৃষ্টি না হওয়ায় ডাক্তার পা কেটে ফেলতে বলেন। কারণ মাংসপেশিতে ও মাংসে পচন ধরে গ্যাংগ্রিন হয়েছিল।
মমদেল জানান, পা কেটে ফেলার বিষয়টি তখন আমি আমার মা-বাবাকে জানাই। আমার বেঁচে থাকার স্বার্থে তারাও সম্মতি দেন। পরে ২৫ জুলাই সেখানে আমার বাম হাঁটুতে সার্জারি করে হাঁটুর খানিকটা উপর থেকে নিচের সব অংশ কেটে ফেলা হয়। এভাবে আমি পঙ্গু হয়ে যাই। জীবনে কখনো ভাবিনি আমাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে।
"