জাহিদুল ইসলাম
সোনালী লাইফের মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস
ভোল পাল্টে সুবিধাভোগী
আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর অনেকটাই আত্মগোপনে চলে গেছেন আওয়ামী শাসনামলের দোসররা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগেও যে ব্যবসায়ী সমাজ শেখ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাদের কেউ করেছেন দেশত্যাগ, আবার কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। তবে বেশির ভাগই নিজেদের ভোল পাল্টে হতে চাইছেন নতুন সরকারের সুবিধাভোগী। এমনটাই জানিয়েছেন অর্থনৈতিক খাত সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতা হারানোর আগ পর্যন্ত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুন নির্যাতনের যে উদাহরণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কায়েম করেছিল, তার নেপথ্যে ছিল সরকারের বিশেষ আনুকূল্য পাওয়া একদল ব্যবসায়ী নেতা। আওয়ামী লীগ শাসনামলে এসব ব্যবসায়ীর প্রায় প্রত্যেকেই ফুলেফেঁপে উঠেছেন। তাদেরই একজন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও ড্রাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুই মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। সে সময় তিনি চট্টগ্রামে সার্কেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জিয়া হত্যাকারী মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেপ্তার করায় ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু জানা গেছে, প্রকাশ্যে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার না নেওয়ার ‘মহানুভবতা’ দেখিয়ে গোপনে অনেক সুবিধা গ্রহণ করেছেন তিনি। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, চাকরিতে থাকাবস্থায় ১৯৮৪ সালে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় ৬৫ বিঘা জমি ক্রয়। এ ছাড়া ১৯৮৬ সালে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পোশাক খাতের ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ১৯৮৬ সালে যখন চাকরি থেকে ইস্তফা দেয় তখন সরকারে ছিলেন সাবেক স্বৈরাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অন্যদিকে বিরোধী দলে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সহকারী পুলিশ সুপার থেকে ইস্তফা দেওয়া গোলাম কুদ্দুস। এরপর ১৯৯৬ সালে কোয়ালিশনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পরের বছরই তিনি বিজিএমইএর সভাপতি নির্বাচিত হন। সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরপর তিন বছর ছিলেন বিজিএমইএর সভাপতি। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেননি। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ফের ক্ষমতায় আসলে পুরোনো বন্ধু হিসেবে আবারও সুবিধা গ্রহণ করতে থাকেন।
২০১৩ সালে দেশের বিমা খাতে সম্পূর্ণ দলীয় কারণে ১৩টি বিমা কোম্পানির অনুমোদন দেয় শেখ হাসিনার সরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া এই ১৩ কোম্পানির মধ্যে একটি হলো- সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স। রাজনৈতিক বিবেচনায় শুধু যে কোম্পানি পেয়েছেন তাই নয়, কোম্পানির পরিচালক পদেও বসিয়েছেন আওয়ামী সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের স্ত্রী হনুফা আক্তার রিক্তাকে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবিরের সঙ্গে ছিল তার গলায় গলায় ভাব। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় রক্ষা পেতে প্রধানমন্ত্রীর চাচা শেখ কবির হোসেনকে ব্যবহার করতেন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রহমাতুল্লাহ বাবুলের সঙ্গে ছবি তুলে তা নিজের সোশ্যাল মিডিয়া আইডিতেও প্রকাশ করেছিলেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী। এমনকি আওয়ামী আস্থাভাজন হওয়ায় গত বছরের ২৩ নভেম্বর তার ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান বাংলাদেশে উরুগুয়ের অনারারি কনসাল হিসেবে নিয়োগ পান।
আওয়ামী সরকারের এত সুবিধাভোগী ও সহযোগী হয়েও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস নিজেকে বিএনপির লোক হিসেবে প্রকাশ করতে থাকেন। দাবি করতে থাকেন, আওয়ামী সরকারের হাতে নির্যাতনের। তবে সম্প্রতি উত্তরা ক্লাবে পোশাক খাতে বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের সংগঠন সম্মিলিত পরিষদের এক অনুষ্ঠানে তিনি তুলোধোনার শিকার হয়েছেন জয়নাল আবেদিন ফারুকের কাছে। যেখানে জয়নাল আবেদিন ফারুক প্রশ্ন রেখে বলেন, আজকে এই প্রোগ্রামে যাদের দেখছি গত ১৬ বছরে তাদের আমাদের পাশে পাইনি। আমার ফ্যাক্টরি বন্ধ ছিল অথচ তাদের কারখানায় কাজ চলেছে। তারা এখানে কীভাবে আসার সুযোগ পায়?
ভোল পাল্টানোর নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে কুদ্দুস পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এমন অনেকে জানিয়েছেন, একজন সরকারি মধ্যম সারির কর্মকর্তা থেকে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস বর্তমানে যে বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন তার পেছনে আছে দখলবাজি ও নানা দুর্নীতি। এসব অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ প্রায় অর্ধডজন সরকারি সংস্থা অনুসন্ধানে নেমেছে। এরই মধ্যে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আরো অনেক কিছু নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। এসব ঘটনায় যেন শাস্তি পেতে না হয়, সে জন্যই মূলত বিএনপি ঘনিষ্ঠ সাজার চেষ্টা করছেন এই ব্যবসায়ী।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মোস্তাফা গোলাম কুদ্দুসের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এই অপপ্রচারগুলো আইডিআরএর চেয়ারম্যান জয়নুল বারীর ছেলে মহসিনুল বারী করছে। তারা যদি এসব করে মজা পায়, করুক। ৫০ বছর আগের এসব ঘটনা নিয়ে আমাদের কেউ মাথা ঘামায় না।
উল্লেখ্য, চতুর্থ প্রজন্মের জীবন বিমা কোম্পানি সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্সে গ্রাহক প্রিমিয়ামের ১৮৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের পক্ষ থেকে গত ২৫ জুলাই মামলা করা হয়। এরপর গত ২২ সেপ্টেম্বর আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউর এক প্রতিবেদনে ৩৫৩ কোটি টাকার অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয়। একই সঙ্গে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে দুদক, সিআইডি এবং আইডিআরএর কাছে চিঠি দেওয়া হয়। এরই মধ্যে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসসহ পরিবার সংশ্লিষ্ট ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, মোস্তফা কামরুস সোবহান, শাফিয়া সোবহান চৌধুরী, তাসনিয়া কামরুন অনিকা, ফজলুতুননেসা, সোনালী লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নূর-ই-হাফজা ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মীর রাশেম বিন আমানের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।
"