প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থান গাথা
খুশির বার্তা এলো ঠিকই এলেন না ফিরে নির্ভীক মিরাজ
প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ফ্রিল্যান্সার মিরাজ গত ৫ আগস্ট বাসা থেকে বের হন। আশায় বুক বেঁধে। তার ডেমরার বাসা থেকে। ভেবেছিলেন ফিরবেন খুশির বার্তা নিয়ে। দীর্ঘ ১৭ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান হবে। আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন পরিবারের প্রিয়জনদের সঙ্গে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। খুশির বার্তা এলো ঠিকই। কিন্তু মিরাজ এলেন না ফিরে। চলে গেলেন না ফেরার দেশে, অকালে।
মিরাজ হোসেন (৩০) গত ৫ আগস্ট বিকেলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হলেও বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করতে পারলেন না তিনি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মিরাজ ছাত্রজীবন থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজপথের প্রতিবাদে অংশ নিতে একটুও দ্বিধা করেননি তিনি।
মিরাজের শোকাহত ছোট ভাই পাভেল হোসেন বাসসকে বলেন, ‘আমার ভাই ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আর এ বছর ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজপথেই ছিলেন।’ আন্দোলনে নিজে যোগদান করার পাশাপাশি মিরাজ তার বন্ধুদেরও আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি ফেসবুক এবং ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক প্রচারণা চালাতেন।
মিরাজের বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী শাওন আল মাহমুদ বাসসকে জানান, আন্দোলন চলাকালীন অন্যান্য দিনের মতো ৫ আগস্ট সকালেও মিরাজ তার সব বন্ধুদের ফোন করে যাত্রাবাড়ী এলাকার শনির আখড়া পয়েন্টে জড়ো হতে বলেন।
সেখানে তিনি নিজের টাকায় বন্ধুদের সবার জন্য জাতীয় পতাকা কিনে দেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জারি করা কারফিউ ভেঙে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। শাওন বলেন, কাজলায় পৌঁছালে দেখতে পাই মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা থেকে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুড়ছে।
তিনি আরো জানান, সে সময় যাত্রাবাড়ী থানার কাছে অনেক দূরের একটি ভবনের ছাদ থেকে কিছু লোককে বিক্ষোভকারীদের ওপর স্নাইপার দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ধারণা করা হয়, পুলিশ ওই গুলি ছুড়ছিল। তবে দুপুর দেড়টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে পুলিশকে থানার দিকে পিছিয়ে যেতে দেখা যায় এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ায় ওই স্নাইপাররাও ছাদ থেকে নেমে যায়।
শাওন বলেন, যদিও শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরের বিষয়ে আমরা তখনো নিশ্চিত ছিলাম না, তবু আমাদের কয়েকজন বন্ধু সেখান থেকেই বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু মিরাজ শাহবাগে যাওয়ার ব্যাপারে অটল ছিল। তিনি আরো বলেন, ‘মিরাজ সেদিন নির্ভীক ছিল। যখন সবাই গুলি থেকে বাঁচতে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করছিল, মিরাজ তখনো পিছু হটেনি।’
শাওন বলেন, ‘বিকেল পৌনে ৩টায় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পৌঁছানোর পরপরই স্টেশনের বাইরে থাকা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় হঠাৎ আমরা দেখতে পাই আমাদের পাশ দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে থানার উল্টো দিকে গেলাম। কিন্তু মিরাজ গুলি থেকে বাঁচার চেষ্টা করেনি।’
ওই সময় থানা ভবনের ছাদ থেকে পুলিশ কাউকে দেখলেই গুলি করছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এ সময়ে মিরাজ গুলিবিদ্ধ হয়। তার বুকের ডান পাশে গুলি লাগে। শাওন জানান, পরে তিনি ফোনে মিরাজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে এক রিকশাচালক ফোন রিসিভ করে মিরাজের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানান এবং প্রথমে তাকে যাত্রাবাড়ীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলেন।
পরে রিকশাচালক তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মিরাজকে মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন শহরের রাস্তাজুড়ে ছিল ভয়ংকর পরিস্থিতি। তাই মিরাজের পরিবারের কেউ হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেনি। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শাওনকেই হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ গ্রহণ করতে হয়।
পুলিশের একটি মাত্র ঘাতক বুলেট ফ্রিল্যান্সিংয়ের একজন উদীয়মান তারকা মিরাজের জীবন প্রবাহ স্তব্ধ করে দিল। এ স্তব্ধতা মেনে নিতে পারছে না তার পরিবার। তারা এখনো শোকের সাগরে ভাসছে। তার গাড়ি চালক পিতা আবদুর রব স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে প্রায়ই হিমশিম খেতেন। বাবার এই জীবন সংগ্রামে সহায়ক হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মিরাজ। আজ মিরাজ নেই। পিতার পাশে কে দাঁড়াবে এই ভেবে দিশাহারা পাভেল।
মিরাজের ভাই পাভেল আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের উপার্জনের টাকায়ই মূলত আমাদের সংসার চলত।’ তাদের একমাত্র বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বাবা এবং মাসহ তাদের তিন সদস্যের একটি পরিবার। কিন্তু মিরাজের মৃত্যুর পর তার বাবা আবদুর রব ও মা মমতাজ বেগম এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
মিরাজের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং তার রক্তমাখা শার্ট দেখাতে গিয়ে মিরাজের বাবা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি এক জায়গাতেই এগুলোকে রেখে দিয়েছেন। এতে তিনি মিরাজের উপস্থিতি অনুভব করেন। তিনি বলেন, ‘ছেলের স্মৃতি মনে করে আমি ও আমার স্ত্রী এসব ধরে কান্নাকাটি করি।’
আমার ছেলে ছিল আমার বন্ধুর মতো। আমি আমার ছেলের স্মৃতি কী করে ভুলি? আমি কীভাবে ভুলি যে আমি যখন কাজলা এলাকার অন্য আহতদের হাসপাতালে যেতে সাহায্য করছিলাম, তখন আমার ছেলে বুকে বুলেট নিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে শুয়ে ছিল?’ এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আবদুর রব।
তিনি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, গত ৫ আগস্ট সকালে মিরাজ দুটি পরোটা এবং ডিমের মামলেট দিয়ে নাশতা করেছিল। নাশতা করার পর সকাল ৮টার দিকে সে আন্দোলনে যোগ দিতে যায়। কে জানত এটাই হবে তার শেষ খাওয়া?
মিরাজ বলত, ‘রিকশাচালকরাও আন্দোলনে নেমেছে। আর আমাদের ঘরে বসে থাকার সুযোগ কোথায়? আমরা দেশকে মুক্ত করব এবং দেশের জনগণকে ভালো রাখার জন্য দেশকে আবার স্বাধীন করব।’
রব বলেন, মিরাজ সবসময় দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করত এবং সে ছিল পরোপকারী। মিরাজের স্বপ্ন ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের জন্য কাজ করার। কিন্তু একটি গুলিতে তার সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
মিরাজের মৃত্যুতে তার বাবা রব এখনো শোকগ্রস্ত। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রব কাঁদতে কাঁদতে বাসসকে বলেন, ‘আমি এখনো কাজ করতে পারি না। আমি কোথাও শান্তি পাই না। আমার ছেলের স্মৃতি আমাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়।’
বিপ্লবে শহীদদের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্র সমন্বয়কদের কাছে বিশেষ করে ৫ আগস্টে নিহতদের কোনো তালিকা নাও থাকতে পারে। চট্টগ্রাম রোড, সাইনবোর্ড, শনির আখড়া, রায়েরবাগ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় যারা নিহত হয়েছেন, শহীদের তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
"