মেহেদী হাসান
এক প্রকল্পে ৩ দফা লুট
রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়িতে অবস্থিত কৃষি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিসে (এআইএস) বিভিন্ন প্রকল্প, প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে বড় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাটের অভিযোগ মিলেছে। এখানকার বেশিরভাগ প্রকল্পেই চলেছে তেলেসমাতিকাণ্ড। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের কথিত উন্নয়নের নামে দফায় দফায় চলেছে লুটপাট। জনগণের টাকা লুটের উন্নয়ন প্রকল্পে একক আধিপত্য ছিল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিসের ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পেও করা হয়েছে দফায় দফায় লুটপাট। ফলে কোনো কাজেই আসেনি শতকোটি টাকার এ প্রকল্প।
খামারবাড়ির কৃষি তথ্য সার্ভিসে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে প্রতিদিনের সংবাদ। সেই প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব থাকছে আজ। অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে প্রথম দফায় লুটপাট করেন প্রকল্প পরিচালক ড. মো. সাইফুল ইসলাম। শাস্তিস্বরূপ চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলাও হয়। ফলে সরানো হয় সাইফুল ইসলামকে। কিন্তু এতে ড. মো. সাইফুল ইসলাম মহাখুশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম প্রকল্পের লুট করা টাকায় ঢাকার উত্তরায় কিনেছেন তিনটি ফ্ল্যাট। টাকা রেখেছেন ব্যাংকে। ফলে প্রকল্পের প্রথম দফা লুটপাটে ‘বরখাস্ত’ হওয়া তার শাস্তির বদলে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়।
সাইফুল ইসলাম বরখাস্তের পর সুকৌশলে প্রকল্পের দায়িত্ব নেন মনিটরিং অফিসার তাপস কুমার ঘোষ। তাপস কুমার প্রকল্পের শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালেই দফায় দফায় লুটপাট করেন প্রকল্পের অর্থ। প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত দুই প্রকল্প পরিচালক ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাবেক পরিচালক আওয়ামী লীগের দোসর ড. সুরজিত সাহা রায়সহ মন্ত্রণালয়ের আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের দিকে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কৃষি তথ্য সার্ভিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিকের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়।
সূত্র বলছে, ২০২৩ সালের ১০ জুন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রশাসন উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম এবং উপসচিব সম্প্রসারণ আবুল কালাম প্রকল্পের ২৯ কোটি টাকার ১৩ ধরনের মালামাল গ্রহণ কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় ডাক অধিদপ্তরের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক মো. আনজীর আহম্মেদের সঙ্গে ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের পরিচালক তাপস কুমার ঘোষ ও মনিটরিং অফিসার মো. মাজাহারুল হোসাইন উপস্থিত ছিলেন। তারপরও প্রকল্পে পুরোনো জংপড়া মেশিন সম্পর্কে কেউই মন্তব্য করেননি। কারণ হিসেবে প্রকল্পে ইচ্ছামতো লুটপাটের সুযোগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্পূর্ণ প্রকল্পের কোটেশনে কেনাকাটার মাধ্যমে নিজের পকেট ভরতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাড ভাড়া নিতেন এ সঞ্জিত কুমার। এরপর নামে-বেনামে সেই ভুয়া সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়ে তুলতেন টাকা। ফলে আপাত দৃষ্টিতে কাজের স্বচ্ছতা দেখালেও ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। ভুয়া সেই প্রতিষ্ঠান মালামাল না কিনেই বিল তুলে নিতেন সঞ্জিত কুমার ভৌমিক। আর সঞ্জিত সেই টাকা দিতেন প্রকল্প পরিচালক ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের তৎকালীন পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়ের হাতে।
সূত্র আরো জানায়, সাবেক প্রকল্পের পরিচালক তাপস কুমার ঘোষের এতই দাপট ছিল, তিনি কোনোকিছুই তোয়াক্কা করতেন না। প্রকল্পের ডিপিডি অনুসরণ না করে অনেক কেনাকাটা করেছেন। তখন তার দাপটে কোনো সরবরাকারী প্রতিষ্ঠানও কোনো কথা বলতে পারত না। কেউ কিছু বললে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের হুমকি দিতেন। প্রকল্পের স্টিল ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাপটপ ভাগাভাগি করে নেন। মনিটরিং অফিসার থাকাকালেই অনিয়ম শুরু করেছিলেন তিনি। প্রতিদিনের সংবাদের হাতে আসা নথি ও সূত্রের তথ্য বলছে, এ প্রকল্পের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, ভিডিও ক্যামেরা এবং স্টিল ক্যামেরাসহ ক্রয়কৃত বেশিরভাগ মালামালই কেনা হয় পুরোনো। আর যে কয়টি ভালো ছিল, সেগুলো কর্মকর্তাদের মধ্যে বিলি করে পুরোনো মার্কেট কিনে নামমাত্র জমা দিয়ে যান। এছাড়া ডিজিটাল অডিও কন্ট্রোল প্যানেল, ডেক্সটপ কম্পিউটার, ডিজিটাল ভিডিও এডিটিং প্যানেল, টাচ স্কিন কিয়স্ক, ল্যাপটপ, রাউটার, স্মার্টফোন, মোবাইল অ্যাপস, মাল্টিমিডিয়া ই-বুক, অডিও-ভিডিও কনটেন্ট, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ক্যামেরা, স্টুডিও ক্যামেরা, ডিজিটাল এসআইআর ক্যামেরা, স্টিল ক্যামেরা ও ফটোকপিয়ার মেশিন কেনাকাটায় করা হয় পুকুরচুরি।
সূত্র বলছে, ঢাকার পুরোনো মার্কেট থেকে ২০ হাজার টাকায় ডেস্কটপ এবং ১৫ হাজার টাকায় ল্যাপটপ কেনা হয়। প্রকল্পের বেশিরভাগ মালামাল কেনায় প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার ঘোষ এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিক মিলে নিজস্ব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা ক্যাশ করে তারপর এ দুজনে মিলে পুরোনো মার্কেট থেকে এসব (ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, ল্যাবটপ ইত্যাদি) পণ্য কিনতেন। পিপিআর-২০০৮-এর তফসিল-২, পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা : ধারা ৯(২)ক পৃষ্ঠা নং-৬৭০ সরকারি বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কোটেশনের মাধমে ক্রয়ের বিধান এবং একই কোডে ৫ লাখ টাকার বেশি হলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধমে ক্রয়ের বিধান রয়েছে, কোনো ধরনের উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করেই ৫ লাখ টাকার মধ্যেই কোটেশনের মাধ্যমে নিজস্ব কোম্পানি বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে বিল উত্তোলন করে অর্থ লোপাট করেছেন প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার ঘোষ।
সব ধরনের কোটেশন, ভাউচার, সার্ভিসিং, জ্বালানি তেল চুরিসহ সব দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত তাপস কুমার ঘোষ। সূত্র বলছে, ঢাকার খিলক্ষেতে তাপস কুমারের ২টি ফ্ল্যাট ও পূর্বাচলে একটি প্লট রয়েছে। এছাড়া নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে তাপসের। সূত্র আরো জানায়, দুর্নীতিবাজ কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাবেক পরিচালক আওয়ামী লীগের দোসর ড. সুরজিত সাহা রায় পরিকল্পনামতে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিক এবং প্রকল্প পরিচালক তাপস কুমার ঘোষ মিলে স্টোর কিপার আরিফুল ইসলামকে দিয়ে জোরপূর্বক ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের নামমাত্র মালামাল বুঝে নেয়। তবে সম্পূর্ণ স্টোরে জমা না দিয়ে ভাগাভাগি করে নেন গুরুত্বপূর্ণ সব মালামাল।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, স্টোর কিপার আরিফুল ইসলাম প্রকল্পের মালামাল নিয়মানুসারে বুঝে নিতে ওয়ার্ক অর্ডারের সঙ্গে মেলাতে চাইলে বিরোধ বাধে আওয়ামী লীগের দোসর এবং ছাত্র-জনতা বিরুদ্ধে ব্যানার-ফেস্টুন সরবরাহকারী, সাধারণ কর্মচারী মাঠে নামানোর মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় এবং তথ্য অফিসার আমিনুর ইসলামের সঙ্গে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে একেক পর এক কারণ দর্শানোর নোটিস দিতে থাকেন পরিচালক। সেইসঙ্গে বিভিন্ন মালামাল না দিয়ে বিল স্টক এন্ট্রি দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর এ আওয়ামী দোসরদের সব পরিকল্পনা বুমেরাং হয়ে যায়। এতে এ দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটটি দিশাহারা হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত একের পর এক ষড়যন্ত্র করছে চক্রটি। তারা থেমে নেই।
প্রকল্পে লুটপাটের সঙ্গে জড়িতের বিষয়ে কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাবেক পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়কে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এর আগে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন। কৃষি তথ্য সার্ভিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিক বলেন, আমি এসবের মধ্যে নেই। আমাকে সুরজিত সাহা রায় স্যার যেভাবে বলেছেন, সেভাবে কাজ করেছি। এমন দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে পারলে দুর্নীতি আর লুটপাট অনেকটাই কমে আসবে। জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
"