হারিছ আহমেদ, কিশোরগঞ্জ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান
পুলিশের গুলিতে পা হারানো জুনায়েদের সংসারে দুর্দিন
মাস শেষ হতেই পরিবার যার দিকে তাকিয়ে থাকত সংসারের খরচের আশায়, তিনি আজ পঙ্গু। তিনি তাকাবেন কোথায়? এখন তো আর আগের মতো টিউশনি করা সম্ভব নয়। রোজগারের একমাত্র ব্যক্তির পঙ্গুত্বে দিশাহারা পরিবার। বলছিলাম কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে হাফেজ মাওলানা জুনায়েদ আহমাদের (২৫) কথা। তার সংসারে নেমে এসছে দুর্দিন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের গুলিতে একটি পা হারান জুনায়েদ। তার বাবা একজন প্রতিবন্ধী। অভাব-অনটনের সংসারে পা হারিয়ে জুনায়েদ হয়ে পড়েছেন পরিবারের বোঝা। তবু সন্তান বেঁচে ফেরায় সৃষ্টিকর্তার দরবারে শুকরিয়া জানিয়েছেন মা-বাবা। পরিবার জানায়, জুনায়েদ যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি মাদরাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালাতেন। অভাব-অনটনের সংসারে পরিবারের একমাত্র রোজগেরে হওয়ায় ছেলেকে নিয়ে বড় আশা ছিল মা-বাবার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ২৫ বছর বয়সে পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে জুনায়েদকে। দেশে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলছে, তখন ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দেন জুনায়েদ।
সেই দিনের ভয়াবহ-দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে জুনায়েদ জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন তিনি। সে কারণে আন্দোলনে যোগদান দেন। ৫ আগস্ট দুপুরে শাহবাগ ও গণভবন ঘেরাও করার কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য মাদরাসার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে রওনা হোন জুনায়েদ। প্রথমে সাইনবোর্ড এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান।
এ সময় সেনাবাহিনী ও বিজিবি তাদের কোনো বাধা দেয়নি। এরপর সামনে এগিয়ে কাজলায় পৌঁছালে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়। সেখান থেকে দফায় দফায় হামলার পর যাত্রাবাড়ী থানা পর্যন্ত পৌঁছালে প্রায় ২টায় গোলাগুলি শুরু হয়। এ সময় একটি ভ্যানের পেছনে গিয়ে আশ্রয় নেন তিনি। দীর্ঘক্ষণ পালিয়ে থাকার পর বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ তাদের কাছাকাছি চলে আসে।
পুলিশের কাছে মাফ চেয়ে পাশের গলি দিয়ে দৌড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে গুলি ছোড়া শুরু করে পুলিশ। তারা খুব কাছ থেকে গুলি করেছে বলে জানান জুনায়েদ। তিনি বলেন, এ সময় সঙ্গে থাকা এক বন্ধু নারায়ণগঞ্জের গোলাম রাব্বি বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আমার বাম পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগার পর আমি পড়ে যাই। দীর্ঘক্ষণ গোলাগুলির পর স্থানীয় লোকজন ও সহকর্মীরা আমাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। সেখান থেকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে জানা যায়, পায়ের দুটি রগ ছিঁড়ে গেছে। অপারেশন করাতে গিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শে আমার পা কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও পা রাখার কোনো উপায় খোঁজে পাননি।
জুনায়েদ আরো বলেন, আমরা দেশ ও জাতির জন্য যতটুকু সম্ভব করেছি। আমার পা হারিয়েছি। বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান আমাদের জন্য কী করবেন, তা জানি না। সংসারে আমিই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি মাদরাসায় টিউশনি করেছি সংসার চালানোর জন্য। বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, তাতে আমরা সবাই আনন্দিত। কিন্তু একটি পা হারানোর ব্যথা যে হারিয়েছে, সেই বুঝে। জুনায়েদের পিতা হাবিবুর রহমান বলেন, জুনায়েদ আমার একমাত্র ছেলে। সে আমার পরিবারের ভরসার জায়গা। খাওয়া-দাওয়াসহ পুরো সংসারের খরচ সেই চালাত। আমি নিজেও অচল। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে। আমাদের সংসারে চলছে এখন অভাব-অনটন।
"