কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম
দেশের বোঝা, গলার কাঁটা
বঙ্গবন্ধু টানেল বন্ধ করলেও ঋণের কিস্তি ঠিকই দিতে হবে, আবার চালু করলেও লস। প্রকল্পের এই শ্বেতহস্তির খরচ মেটাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ২৮ লাখ টাকার মতো। বঙ্গবন্ধু টানেল এখন দেশের বোঝা গলার কাটা। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখানো এই টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। চীন সরকারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বানানো এ টানেলের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে আগামী বছর থেকেই। উচ্চাভিলাসী এ প্রকল্পে প্রতি দিন আয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকার মতো, আর ব্যয় প্রায় ৩৮ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে গত ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত বিপুল ব্যয়ের আড়ালে আয়ের চিহ্নও মিলছে না। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার গাড়ি চলার কথা জানানো হলেও চলছে ৩ হাজারের কম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এক শ্রেণির আমলা ও রাজনীতিবিদ মিলে গ্রহণ করে উচ্চাভিলাসী এ পরিকল্পনা। অনেক বিশেষজ্ঞের বারণও কানে তোলেনি সরকার। সরকার বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছে দেশ টানেল জগতে প্রবেশ করছে। টানেল নির্মাণের জন্য আগ্রহ দেখায় চীন। ২০১৬ সালে চীন থেকে পর্যবেক্ষক দল পরিদর্শন করে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকা। ওই বছরের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সিদ্ধান্ত হয় চীন ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে টানেল নির্মাণ করবে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চলে নানা স্টাডি। চীনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন টানেল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন’ লিমিটেড টানা সাড়ে ৪ বছর ৮ মাস করার পর টানেল নির্মাণ শেষ করে। গত ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিপুল টাকা ব্যয়ে উদ্বোধন করা হয় প্রকল্পটির। সব মিলে শেষ পর্যন্তÍ ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
কতিপয় সরকারি আমলা ও বন্দরের কতিপয় কর্মকর্তার পরামর্শে বিশেষজ্ঞদের বারণ কর্ণপাত না করেই সরকার বিশাল এ কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়। কর্মকর্তারা জানায়, বিদেশিরা টানেলকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে সরাসরি টানেল ভেতর দিয়ে যাওয়া যাবে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। পর্যটনশিল্পের জন্য ইতিবাচক বিনিয়োগও হাতছানি রয়েছে বলে জানানো হয়। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে অন্তত ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে বন্দর। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ পরিবহন করে ডেনমার্কের মার্কস লাইন। ডেনমার্ক ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ব্যবসা করলেও নিজস্ব কোনো বিনিয়োগ ছিল না। বর্তমানে টানেল ঘিরে মার্কস লাইনের ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নতুন কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে লাগানো বলে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নদীর তলদেশের এই টানেল। এ সময় বন্দর আরো জানায়, এরই মধ্যে বিদেশি ৭টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে এবং নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালে ডি পি ওয়ার্ল্ড এবং রেড সি ছাড়াও সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি, ভারতের আদানি গ্রুপ ও নেদারল্যান্ডসের এপি টার্মিনাল বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
টানেল নির্মানের আগে এসব স্বপ্ন দেখানো হলেও বন্দরের বর্তমান প্রশাসন এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলছে না। এগুলো আদৌ সম্ভব, নাকি স্বপ্ন তা নিয়ে মুখ খুলছে না কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এগুলো আগের চেয়ারম্যানের দায়ভার। তিনি তার ইচ্ছে মতো কাজ করেছেন। কথা বলেছেন। এখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই।’
বিষয়টি নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বলেছেন, ‘স্বল্প মেয়াদে এটার আয় দিয়ে এটি নির্মাণে যে খরচ হয়েছে সে খরচ তোলা যাবে না। সেদিক থেকে এটা শর্ট টার্মে এটা বোঝা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের উপরে। আগামী ৫-৭ বছরে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হবে না। ফলে প্রথম দিকে এটি বাংলাদেশের উপরে একটি বোঝা হয়ে থাকবে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সহসাই হবে না বলেও মনে করেন তিনি। এই পর্যায়ে এসে এখান থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। এটা আন্ডার ইউটিলাইজ (কম ব্যবহৃত) হবে কয়েক বছর, এটা মেনে নিতেই হবে।’
একই মন্তব্য করেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের যোগাযোগ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘সঠিক সমীক্ষা ছাড়া একটি অবাস্তব প্রকল্প ছিল কর্ণফুলী টানেল। এখন কী করে এই লোকসান কমানো যায় আমরা সেই পর্যালোচনা করছি।’ আন্তর্জাতিক
পরামর্শক প্রকৌশলী এম এ সবুর প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এ প্রকল্পটি আসলে অনেক পরে হওয়ার কথা। কারন মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মাণ করা হলে এটি গুরুত্বহীন হবে। মেরিন ড্রাইভওয়ের মাধ্যমে দেশের সমুদ্রবন্দরের পাড় ঘেঁষে চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকা-কক্সবাজারের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনীয় লিংক অবকাঠামো এখানে নির্মাণ করা হয়নি। এ অবস্থায় শুধু টানেল দিয়ে নদীর ওপারে যাতায়াত ছাড়া আর কিছুই সম্ভব না। আর এ ধরনের একটি বড় প্রকল্প করতে হলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগুলো আগে দাঁড় করাতে হবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি লোকসানের কারণ খুঁজতে এরই মধ্যে সেতু সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনের পর তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঋণের টাকায় নির্মিত হওয়ায় এই প্রকল্প থেকে থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয়ও তোলা সম্ভব না। ফলে টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়েই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মানের পরিকল্পনার বিষয়টি প্রকাশের পর চট্টগ্রামের বিএনপি নেতারা এ সময় এটি নিয়ে অনেক হাস্যরস করেছেন। বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিএনপি নেতারা একে পাগলের প্রলাপের সঙ্গে তুলনা করেন। শেষ পর্যন্ত তাদের কথা যে সত্যি পরিণত হবে এমনটা তখন কেউ ভাবেননি।
"