এম এ মাসুদ, সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা)
তিস্তা ফিরিয়ে দিলেও জমি গ্রাস করল ভাতিজারা
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের অশীতিপর আমিরন বেওয়া। স্বাধীনতার আগে তার ৮ ও ৬ বছরের ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে রেখে পরপারে পাড়ি জমান স্বামী সৈয়দ আলী। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুরের জমাদারের চরে স্বামীর সামান্য জমিজিরেত ছিল। কিন্তু ছেলেমেয়ে ছোট হওয়ায় তা চাষাবাদ করতে পারতেন না আমিরন। সেই জমিতে ভাসুর ও দেবর চাষাবাদ করত আর মন কয়েক ধান দিতেন তাকে। তা দিয়েই চলতে হতো তাকে। পরে আশির দশকের মধ্যভাগে তিস্তার করাল গ্রাসে চলে যায় বসতভিটে। এরমধ্যে ছেলের মৃত্যু হয়। সর্বস্বান্ত হয়ে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন পাশের গ্রাম পুঁটিমারিতে। ঠাঁই নেন অন্যর বাড়িতে। পরে নব্বই দশকের শেষভাগে শান্ত হয় তিস্তা। জেগে ওঠে চর। এবার মেয়েকে নিয়ে স্বামীর ভিটেয় ফেরার চেষ্টা করেন আমিরন। এবার বাধ সাধেন তারই ভাসুর ও দেবর। পরে ভাসুর দেবরের মৃত্যুর পর তাদের ছেলেরা দখল নেন বৃদ্ধার শেষ সম্বল। তিস্তা ফিরিয়ে দিলেও সেই জমি গ্রাস করল তারই ভাতিজারা।
ভেসে ওঠা জমিতে ধান, গম, পাট ও বাদাম ভালো ফলায় বৃদ্ধা ও তার মেয়ের ভাগের ২ দশমিক ৬৯ একর জমি দখল করে নেন ভাসুর আবেদ আলী ও দেবর মোসলেম আলী। তারা পাত্তা দেন না বৃদ্ধা আমিরনকে। এক সময় আবেদ ও মোসলেম আলীও মারা যান। তারা মারা গেলেও জমির দখল নেন আবেদ আলীর ছেলে আশেক আলী এবং মোসলেম উদ্দিনের ছেলে আবদুল হাকিম ও আবদুল হাই। সেই সঙ্গে দখল নেন বৃদ্ধার জামাই-এর কেনা ১৮ শতক জমিও।
ভাসুর ও দেবরের ছেলেদের জবরদখলে সামান্য জমিজিরেত ও ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসেছেন আমিরন। নিজের জমিজমা থাকার পরও আহার জোটাতে এখন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে তাকে।
শুধু তাই নয়, বৃদ্ধার মেয়ে ছবুরা, জামাই ফয়জার, নাতি আবদুস সামাদ, ননদের ছেলে তোজাম্মেল হক, তার ভাই স্বাস্থ্য পরিদর্শক আজিম উদ্দিন ও ফয়জারের নাতি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কামরানসহ ১৩ জনকে আসামি করে ২১০ মণ ভুট্টা ও ১৮ মণ বাদাম চুরির মামলা দেন তারা। পরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাশিদুল কবিরের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় খারিজ করে দেন আদালত।
শুধু তাই নয়, বছর দুয়েক আগে থানায় এক বৈঠকে জমিজমা ও ভিটেমাটি দেওয়ার অঙ্গীকারও করেন জবরদখলকারীরা। কিন্তু সে অঙ্গীকারও রক্ষা করা হয়নি।
আমিরনের জমিতে ফলছে সোনার ফসল। অথচ আমিরন থাকছেন অনাহার-অর্ধাহারে। অভাব অনটন আর বয়সের ভারে দাঁড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তবু চুপে চুপে দেখতে যান সেই ফসলি মাঠ। আর কেঁদে কেঁদে বুক ভাসান। এ প্রতিবেদককে বলেন, জমিতে গেলেই মারে ভাতিজারা। জামাইকে মেরে কোমার ভেঙে দিয়েছে। ভাতিজারা বলে, আমার জমির ফসল বিক্রি করে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা চালাবে। মামলা দিয়ে দিয়ে মেয়ে, জামাই, নাতি ও নাতির ছেলেদের হয়রানি করছে ওরা। জামাইকে মেরে কোমার ভেঙে দিয়েছে। তাই জমি উদ্ধারে ইউএনওর কাছে বিচার দিয়েছি।
বৃদ্ধার জমি জবরদখলে করার বিষয়ে জানতে চাইলে বৃদ্ধার দেবরের ছেলে আবদুল হাই বলেন, চাচি ও চাচাতো বোন ও ফুফু আয়েশা জমি পান। ফুফুর জমি কেনার পর তাদের জমিও নেব। তাহলে চুরির মিথ্য মামলা দিয়েছেন কেন-জবাবে বলেন, আমি করিনি। বড় ভাই আবদুল হাকিম করেছে।
বিষয়টি জানতে চাইলে তারাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি মীমাংসার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলাম। পরে মারামারি ও মামলা হওয়ায় আর মীমাংসা হয়নি।
বৃদ্ধার অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজির হোসেন বলেন, এসিল্যান্ডকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এখতিয়ারভুক্ত বিষয় হলে বিধি মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
"