নিজস্ব প্রতিবেদক
ডেঙ্গু রোগীদের ৮৫ শতাংশ ‘ডেন-২’ আক্রান্ত
ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি বাড়ছেই। বদলেছে ডেঙ্গুর ধরন। বছরব্যাপী ডেঙ্গু থাকলেও, তিন বছর ধরে প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকছে আগস্ট, সেপ্টম্বর ও অক্টোবর মাসে। রাজধানীতে এ বছর ডেঙ্গু রোগীদের ৮৫ শতাংশেরও বেশি ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপ-২ (ডেন-২) দ্বারা আক্রান্ত বলে আইসিডিডিআর’বির সম্প্রতি ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে। আর এই সেরোটাইপটি আগামী দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা।
বাকি রোগীদের অধিকাংশ ‘ডেন-৩’ এবং কিছু রোগী ডেঙ্গুর ‘ডেন-১’ ধরনে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ‘ডেন-২’ ধরনে আক্রান্তের হার প্রায় ৯০ শতাংশ। গত বছর ডেঙ্গুতে দেশজুড়ে ছিল ভয়াবহ পরিস্থিতি, যার প্রভাব এ বছরেও রয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর মৃত্যু কম হলেও মৃত্যুর হার কাছাকাছি। ২০২৩ সাল থেকেই ডেঙ্গুর প্রভাবশালী সেরোটাইপ ‘ডেন-২’ এর ব্যাপক বিস্তার চলমান এই সংকটের মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এবারে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর এক্ষেত্রে একটু বয়স্ক এবং নারীরা বেশি মারা যাচ্ছেন। যারা হৃদরোগ, কিডনি, ডায়বেটিস’সহ অন্য জটিল রোগে আক্রান্ত- তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।
আইসিডিডিআর’বির সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘ডেঙ্গুর একটি ধরন নতুন করে আসলে তখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেড়ে যায়। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছিল ডেন-৩। এরপর ২০২৩ থেকে ডেন-২ ফের আসে; ফলে গত বছর আমরা ডেঙ্গুতে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। তিনি বলেন, এর মূল কারণ হচ্ছে একই ব্যক্তি যখন ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হন, তখন তার মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।’
এই গবেষক আরো বলেন, ‘ডেঙ্গুর চারটি ধরন (ডেন-১ থেকে ডেন-৪) এর মধ্যে এখন দেশে ডেন-২ এবং ডেন-৩ বেশি দেখা যাচ্ছে। অল্প কিছু রোগী ডেন-১-এ আক্রান্ত। এবার ৮৫ শতাংশেরও বেশি রোগী ডেন-২-তে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গুর চারটি ধরনের একটিতে পজিটিভ হলে পরবর্তী সময়ে ওই ধরনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তেমন থাকে না। তবে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগীর শারীরিক অবস্থা গুরুতর হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুতে অধিকাংশ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে অবহেলার কারণে। ৮০ শতাংশ মানুষ বুঝতেই পারেন না যে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার অনেক সময় ডেঙ্গু টেস্ট করলেও ধরা পড়ছে না। ডেঙ্গুর আইজিএম টেস্ট করালে ধরা পড়ছে। তাই অনেকেই চিকিৎসা নিতে অবহেলা করার কারণে শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছেন।’
আইইডিসিআরের সায়েন্টিফিক অফিসার (ভাইরোলজি বিভাগ) ডা. আবদুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, সাধারণত ডেঙ্গুর একটি সেরোটাইপের প্রাধান্য থাকে তিন থেকে চার বছর। এ সময় বড় একটি সংখ্যক মানুষ এই সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মধ্যে ইমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি) হয়। গত বছরও সেরোপটাইপ-২-এর প্রাধান্য দেখা গেছে। যেহেতু এবার সেরোটাইপ (ডেন-২) রয়েছে, সুতরাং আগের সেরোটাইপটার জন্য মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি আছে। সে হিসাবে বলা যায় ডেন-২ আক্রান্ত করতে পারবে এমন সুযোগ কম। তবে ঢাকার বাইরে বড় একটি সংখ্যক মানুষ যারা ডেন-২ আক্রান্ত হয়নি। তাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে।
ডা. আবদুল্লাহ ওমর নাসিফ আরো বলেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেন-২ বা সেরোটাইপ-২ এর প্রাধান্য ছিল। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছিল সেরোটাইপ-৩। এরপর ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে সেরোটাইপ-২ প্রভাব বিস্তার করছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসাইন বলেন, ‘দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ না হলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কমানো সম্ভব না। বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পদ্ধতির পরিবর্তন করা জরুরি। কোনো ব্যক্তি জ্বরে আক্রান্ত হলেই যেন সে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে পারেন যে, তার ডেঙ্গু হয়েছে কিনা। এজন্য কমিউনিটি ক্লিনিকসহ পরীক্ষা ব্যবস্থা মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে যেতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি হতেই পারেন, কিন্তু এটিতে মৃত্যু হওয়ার মতো পরিস্থিতি কেন তৈরি হবে? বর্তমান সরকার ডেঙ্গু রোগী খুঁজতে কিংবা মশার ঘনত্বপূর্ণ এলাকা খুঁজতে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগাতে পারে। আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বৃত্তের বাইরে এসে কাজ করতে হবে। এজন্য দরকার উদ্যোগ। দেশ রক্ষায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যেমন রাস্তায় নেমে এসেছিল, সব পাবলিক হেলথের বিষয়েও উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় লোকজনকে সম্পৃক্ত করলে তারাও উদ্যোগী হবে কাজে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার যদি ডেঙ্গুর চিকিৎসাব্যবস্থা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চপর্যায়- এই তিন ভাগে ভাগ করে চিকিৎসা দেয়, তাহলে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ও মৃত্যুহার কমানো সহজ হবে।’
একই সঙ্গে গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা সুবিধা উন্নতি করাসহ সিটি করপোরেশন ও রেলওয়ে হাসপাতালগুলো ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি। ২০১৯ সালে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১ দশমিক ১৯ লাখ মানুষ। ওই বছর মারা যায় ১৭৯ জন। এই রোগীদের মোটামুটি সবাই ডেঙ্গুর নতুন ধরন ‘ডেন-৩’ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছায় ১ হাজার ৭০৫ জনে, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
"