প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণঅভ্যুত্থান গাথা
রিফাত গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান নানা
গত জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার বিভৎসতা সহ্য করতে না পেরে রাজপথে নামেন প্রতিবাদী জনতা। বিবেকের তাড়নায় নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি ১৮ বছরের তরুণ রিফাত হোসেন। জীবনের ঝুঁকি জেনেও যোগ দেন আন্দোলনে। তার পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নের সুখীপুর গ্রামে। বাবা মো. হানিফ মারা গেছেন রিফাতের জন্মের দেড় বছর বয়সে।
গত তিন বছর থাকতেন একই ইউনিয়নের দশপাড়া গ্রামে বড় বোন হালিমার বাড়িতে। রিফাতের দুলাভাই সাইদুল ইসলাম জানান পহেলা আগস্ট থেকেই রিফাত সক্রিয় ছিলেন বাড়ির কাছাকাছি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শহীদনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। সেখানে পুলিশের অবস্থানও ছিলো কঠোর। তারপরও ভয় উপেক্ষা করে অন্যদের সাথে রিফাতও মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। প্রতিদিনই পুলিশের বাধার মুখে পড়েছে ছাত্র-জনতার মিছিল। তবে শহীদনগরে পুলিশ ততটা মারমুখী ছিলো না। কিন্তু ৪ আগস্ট পুলিশের সামনেই বন্দুকসসহ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নামেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তখন পুলিশ ছিলো নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায়। সে সুযোগে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে অতর্কিত হামলা ও এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ অন্য নেতাকর্মীরা। এতে চারজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতা। সেদিন দুপুর দেড়টায় এ নারকীয় হামলায় শিক্ষার্থীদের রক্তে রঞ্জিত হয় পিচঢালা রাজপথ। শহীদনগরে এ হামলার পর এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। কারণ সে সময় আহতদের উদ্ধার চেষ্টাকারীদের প্রতিও চড়াও হয় হামলাকারীরা। পুলিশও সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়। গুলিবিদ্ধ চার জনের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি ছিলো কিশোর রিফাতের। বুক ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তার শরীর থেকে রক্ত ঝরে অঝোরধারায়। বন্ধুরা কোনো মতে ধরাধরি করে তাকে ভ্যান গাড়িতে উঠায়। এ সময় ছড়িয়ে পড়ে রিফাত মারা গেছে। যদিও তখনও তার কিছুটা নিঃশ্বাস ছিলো।তখন অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে গৌরীপুরে দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। অপরদিকে রিফাতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে হার্ট অ্যাটাক করেন তার ষাটোর্ধ্ব নানা মো. আলম। বিকাল ৩টায় তার মৃত্যু হয়। সেদিন রাত ১০টায় তার জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। অপরদিকে রাত ১ টায় হাসপাতাল থেকে রিফাতের মৃত্যুর খবর আসে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পর দিন ৫ আগস্ট বাদ জোহর দশপাড়া শাহী ঈদগাহ মাঠে তার জানাজায় মুসল্লিদের ঢল নামে।এ সময় ঘৃণ্য এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। পরবর্তী সময়ে তার বাসায় গিয়েও শোক প্রকাশ করেন অনেক নেতৃবৃন্দ। অনেকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাসও দেন। দুলাভাই সাইদুল ইসলাম জানান, বাবার মৃত্যুর পর থেকে রিফাতের মা নিপা বেগম ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করছেন। এ সময় রিফাতকে নানা বাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। সর্বশেষ গত তিন বছর বোনের বাড়ি থেকে পাইপ ফিল্টারের কাজ করতেন। জুলাইয়ের শেষের দিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হাতে কাজ ছিলো না। তাই তাদের দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে হামলা ও নির্বিচারে গণহত্যার খবর শুনে তাদের মনে দাগ কাটে। সে উপলব্ধি থেকে শেষ কয়েক দিন রিফাত ও তার দুলাভাই এলাকার অন্যদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়া শুরু করেন। গত ০৪ আগস্ট সকালে রিফাতকে নিয়ে একসাথে নাশতা করেন সাইদুল। নাশতা শেষে মিছিলে যোগ দেন। কিন্তু রিফাতকে চিরতরে হারিয়ে ফেলতে হবে তা কল্পনাও করেননি তিনি। সাইদুল অবিলম্বে খুনিদের বিচার দাবি করেন।
তিনি জানান, রিফাত শহিদ হওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বাসায় আসেন। তারা বিভিন্ন সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তবে তেমন সাহায্য তারা এখনও পাননি। উপজেলা প্রশাসন মাঝে-মধ্যে খোঁজ-খবর নিলেও কোনো সহায়তা দেয়নি। তবে গত ১০ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা সফরকালে কয়েকটি শহিদ পরিবারের সদস্যদের সাথে রিফাতের পরিবারের সাথেও দেখা করেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। তখন তিনিও বিভিন্ন ধরনের আশ্বাস দেন। সম্প্রতি ঢাকায় ডেকে নিয়ে রিফাতের হাতে ৫০ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড উপহার দেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ। অন্যদিকে রিফাত হত্যার ঘটনায় কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-তিতাস) আসনের তৎকালীন এমপি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর, উপজেলা চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী সুমন, আওয়ামী লীগ নেতা নাঈম ইউসুফ সেইন, জায়গীরের আবদুস ছাত্তার তালুকদার,বাহেরচরের সালেহ আহমেদ টুটুল ও পশ্চিম মাইজপাড়া এলাকার মহিউদ্দিন সিকদারসহ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৫৫ নেতাকর্মীকে আসামি করে কুমিল্লার আদালতে একটি হত্যা মামলা করেছেন মা নিপা বেগম। অবশ্য আসামিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ করেছেন রিফাতের বোন হালিমা আক্তার। তিনি ভাই হত্যায় জড়িত খুনিদের ফাঁসি দাবি করেন।
এদিকে দাউদকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাঈমা ইসলাম বলেন, রিফাতের পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে।তবে তিনি নতুন যোগদান করায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে কি না জানাতে পারেন নি। অবশ্য সরকার এ সংক্রান্ত কোনো অনুদান বরাদ্দ দিলে তা যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়ার আশ্বাস দেন।
"