প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২১ অক্টোবর, ২০২৪

গণঅভ্যুত্থান গাথা

সহযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন আসিফ

বৃদ্ধ পিতা ও সৎমাকে কথা দিয়েছিলেন আসিফ, মিছিলে যাবেন না। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মাটিতে লুটিয়ে পড়া এক সহকর্মীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান সাতক্ষীরার মেধাবী ছাত্র আসিফ হাসান (২১)। আসিফের শহীদ হওয়ার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও মা হারা সন্তানের অকালমৃত্যুতে এখনো শোকে স্তব্ধ গোটা পরিবার। ছোটবেলা থেকে কোলে পিঠে মানুষ করা সৎমা শিরীন সুলতানা এখনো মনে করেন তার সন্তান বেঁচে আছে। সে যে মারা গেছে এটা তিনি কোনোভাবেই যেন মানতে পারছেন না। এখনো বৃদ্ধ পিতা মাহমুদ আলম ও তার সৎমা পথ চেয়ে বসে থাকেন তাদের সন্তান আবারও ফিরে আসবেন এই আশায়।

জানা যায়, আসিফের জন্ম সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে দেবহাটা উপজেলার আস্কারপুর গ্রামে। পিতা মাহমুদ আলম (৬০) এবং সৎমা শিরীন সুলতানা (৪০)। আসিফের প্রকৃত মা মরিয়ম বেগম মারা গেছেন। মাহমুদ আলমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট যমজ দুই সন্তান আসিফ হাসান ও রাকিব হাসান। দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে আসিফ বড়। তার বড় বোন মাকসুদা আক্তার মুন্নি (৩৮), মেজো বোন মুন নাহার পারভীন (৩২) ও ছোট বোন জেসমিন সুলতানা (২৫)। বোনেরা সবাই বিবাহিত।

গত ১১ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আসিফের মায়ের মৃত্যু হয়। ছোটবেলা থেকেই সৎমায়ের সংসারে আদর যত্নে বেড়ে ওঠে আসিফসহ তার ভাইবোনেরা। কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা আহছানিয়া রেসিডেন্সিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন আসিফ হাসান। এরপর ঢাকায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়টির উত্তরা ক্যাম্পাসে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত ছিল আসিফ হাসান। সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদে আসিফ বাড়িতে এসেছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহর যখন উত্তাল হয়ে ওঠে তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আসিফের পরিবার।

গত ১৮ জুলাই দুপুরে আসিফের সঙ্গে তার মেজো বোন ঢাকার খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মুন নাহার পারভীনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। তার বোন তার কাছে শুনতে চায় ভাই তুমি কোথায় আছো? অনেক গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। আসিফ তখন তার বোনকে বলেন, আপা আমি মিছিলের শেষের দিকে আছি আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমি নিরাপদে আছি। ফাঁকা গুলি ছুড়ছে আমাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য। বোন মুন নাহার এ সময় তাকে বলেন, তুমি মিছিল ও আন্দোলন থেকে পেছন দিক থেকে চলে যাও। আর সেখানে না থাকার জন্য তিনি তার কাছে অনুরোধ করেন। এরই মধ্যে আসিফ তার বোনকে জানান, আপা তুমি পরে ফোন করো। আমাদের এক ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সে পানি খেতে চাচ্ছে। তাকে পানি খাওয়াতে হবে। এই বলে আসিফ তার আশপাশের সহযোদ্ধাদের ডাক দিয়ে গুলিবিদ্ধ বড় ভাইকে পানি খাওয়ানো ও তাকে সেখান থেকে সরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং তার বোনের সঙ্গে এটাই তার শেষ কথা। এদিকে তার বোন তাকে মোবাইল ফোনে হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছেন। ১ মিটি ৩৪ সেকেন্ড আসিফ তার বোনের সঙ্গে কথা বলেন বলে তার বোন জানান। এরপর তার বোন তাকে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি আর ফোন ধরেননি। গুলিবিদ্ধ বড় ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে এ সময় তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। গুলিবিদ্ধ আসিফ হাসানকে তার সহযোদ্ধারা পরে কুয়েত বাংলাদেশ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় আসিফ মারা গেছেন।

অশ্রুসিক্ত নয়নে তার মেজো বোন মুন নাহার আরো জানান, আসিফ মারা যাওয়ার ১২-১৪ দিন আগেও তার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কয়েক দিন ছিলেন। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটিতে চলে যান। তিনি জানান, শাটডাউনের মধ্যে গত ১৭ জুলাই তিনি তাকে বলেছিলেন তার বাসায় যাওয়ার জন্য। আসিফ তার বোনকে বলেন, যানবাহন সব তো বন্ধ তাহলে কীভাবে যাবেন। তার বোন এ সময় তার এলাকা থেকে তাকে আনার জন্য পরিচিত কোনো বাইক পাঠানোর জন্য তাকে প্রস্তাব দেন। এতে আসিফ সম্মতি দেননি। তিনি এ সময় আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন, মহান আল্লাহপাক ওখানে তার মৃত্যু লিখেছেন। এজন্য সে সেখানেই শহীদ হয়েছে।

শহীদ আসিফ হাসানের সৎমা শিরীন সুলতানা জানান, অনেক ছোট বেলা থেকেই আমি আসিফ ও রাকিবকে মানুষ করেছি। আমার মনেই হচ্ছে না আমার আসিফ নেই। মনে হচ্ছে আমার আসিফ আবার আমার কাছে আসবে। তিনি এ সময় অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আমার আসিফ বড় বড় ভেটকি মাছ, পার্শে মাছ, চিংড়ি মাছ ও গরুর গোশ খেতে ভালোবাসত। বাড়ি আসলেই তার এসব খাওয়ার আবদার ছিল। রান্নার পর এসব গরম গরম খাবার খেতে ভালোবাসত। আমি অনেক সময় তাকে বলতাম বাবা ঠাণ্ডা হলে খাও। সে আমাকে বলত মা গরম গরম ভালো লাগে। তিনি মেনেই নিতেই পারছেন না তার আসিফ আর নেই।

আসিফের ছোট ভাই সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রকিব হাসান জানান, ছোটবেলা থেকেই আমাদের দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যা করতাম দুই ভাই পরামর্শ করেই করতাম। কোটা আন্দোলন শুরু থেকেই তার সঙ্গে আমার প্রতিদিনই কথা হতো। গত ১৬ জুলাই সে প্রথম আন্দোলনে যায়। এরপর ১৮ জুলাই আন্দোলনে যাওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে ফোন করে আসিফের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। ওই দিন রাতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আসিফের মরদেহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। পরদিন জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় তাকে শায়িত করা হয়।

তিনি আরো বলেন, আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার সব সময় কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে কথা হতো। আমিও কোটা আন্দোলন নিয়ে সাতক্ষীরায় অনেক মিছিল ও সমাবেশ করেছি। আন্দোলন সংগ্রামে আমার ভাই আমাকে সবসময় সাবধানে থাকার জন্য অনুরোধ করত। মারা যাওয়ার আগের দিনও আমাকে সে বলে আমি একটু ভয়ে ভয়ে আছি, কারণ বিভিন্ন মেসে অভিযান চলছে। কখন যে আমাকে ধরে ফেলে? ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি এ সময় বলেন, কী বলব ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

আসিফের ছোট চাচা মামুন হোসেন জানান, তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো আস্কারপুর গ্রামে। শোকে স্তব্ধ আমাদের গোটা পরিবার। আসিফ আমার শুধু ভাইপো ছিল না সে আমার বন্ধুর মতো ছিল। গ্রামের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আসিফ ও আমি একসঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতাম। অনেক সামাজিক ছেলে ছিল সে।

শহীদ আসিফের বাবা মাহমুদ আলম জানান, আমি দুই থেকে তিন দিন পরপর আসিফকে ফোন করে ওর খোঁজখবর নিতাম। আমি ওকে বাড়িতে চলে আসতে বলেছিলাম। ও বলল আব্বা আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আমি আন্দোলনে যাচ্ছি না। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে পরে কখন যে সে আন্দোলনে গেল তা আমি জানি না। আমি ভাবতেই পারছি না আমার আসিফ নেই। তার বড় ইচ্ছা ছিল ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সে দেশের বাইরে যাবে। কিন্তু কি যে হয়ে গেলো তা আমি আর বলতে পারছি না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close