রাহাত চৌধুরী, জাবি

  ২০ অক্টোবর, ২০২৪

গণরুমবিহীন স্বপ্নযাত্রা

দেশের একমাত্র স্বীকৃত পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দুই দশক ধরে একটু একটু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার আবাসিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছিল। সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেতারা ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও রুম ছাড়ত না। চারজনের রুমে দুজন বা একা থাকত সংগঠনটির নেতারা। কৃত্রিম সিট সংকট তৈরি করে নবীন শিক্ষার্থীদের ‘গণরুমে’ উঠতে বাধ্য করত। জুলাই বিপ্লবের পর ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছাড়া হওয়ায় প্রতিটি হলেই সিট সংকট কেটে গেছে। হল প্রশাসন সিট বণ্টনের দায়িত্ব নিয়ে প্রতিটি হলেই শিক্ষার্থীদের সিট নিশ্চিত করছে। ভর্তি হওয়ার পর নবীন শিক্ষার্থীরা প্রথমেই পেয়ে গেলেন তাদের অধিকার। গণরুমের দুর্বিষহ নিয়তি থেকে পরিত্রাণ পেলেন তারা।

পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিন থেকে একটি সিট, পড়ার জন্য একটি টেবিল ও চেয়ার নির্ধারিত থাকলেও এত দিন তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। নবীন শিক্ষার্থীদের ঠাঁই হতো হলের গণরুমে। কমন রুম, ডাইনিং রুম, রিডিং রুম, সংসদ রুম, নামাজের কক্ষ ও সাইবার রুমের মেঝেতে। সেখানে গাদাগাদি করে একজনের জায়গায় কম করে হলেও তিন থেকে চারজন শিক্ষার্থীকে থাকতে হতো। প্রথম বর্ষ গণরুমে পার করে দ্বিতীয় বর্ষে জুটত ‘মিনি গণরুম’।

সেখানে তাদের দুজনের রুমে ছয় থেকে আটজন এবং চারজনের রুমে ১৪ থেকে ১৬ জন থাকতে হতো। এভাবে দ্বিতীয় বর্ষ পার করে তৃতীয় বর্ষে এসে একটি সিট জুটলেও পলিটিক্যাল-ননপলিটিক্যাল ভেদে চারজনের রুমে থাকতে হতো ৬-৭ জনকে। দেখা যেত, চতুর্থ বর্ষ বা মাস্টার্সে এসে শিক্ষার্থীরা চারজনের রুমে থাকার সুযোগ পেত। এমন চিত্র ছিল ছেলেদের হলগুলোয়। মেয়েদের হলে অপেক্ষাকৃত আগে সিট পাওয়া গেলেও হলভেদে তাদেরও প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে গণরুমে থাকতে হতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের ১১টি এবং মেয়েদের ১০টিসহ মোট ২১টি হল রয়েছে। যার আসন সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় অধিক। মূলত আবাসিক হলগুলো এত দিন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারাই শিক্ষার্থীদের সিট দিত। এ ছাড়া ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও অবৈধভাবে রুম দখল করে চারজনের রুমে দুজন বা একা থাকত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে ছিল নীরব, গণরুম দূর করতে ছিল না কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ। ফলে ১০ তলা বিশিষ্ট নতুন ছয়টি হল নির্মাণের পরও সিট সংকট কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। কৃত্রিম সিট সংকট ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।

আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ ব্যাচের (২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীদের ক্লাস। এর আগেই, গতকাল নবীন শিক্ষার্থীরা নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দ একটি সিট বুঝে পেয়েছেন। যা ছিল এত দিন অকল্পনীয়। প্রতিটি হলেই শিক্ষার্থীরা একটি বেড, টেবিল ও চেয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন। কক্ষ ভেদে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সিটে উঠার সুযোগ পেয়েছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন হলে নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে আয়োজন করেছে হল প্রশাসন ও হলের শিক্ষার্থীরা। নবীনদের ফুল, কলম এবং মিষ্টি দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা নোটিশ বোর্ড থেকে কক্ষ নম্বর দেখে নির্ধারিত সিটে উঠছেন। প্রতিটি কক্ষেই ছিল প্রত্যেকের জন্য একটি বেড, টেবিল ও চেয়ার। হলে শিক্ষার্থীদের কক্ষে গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা।

হলগুলোয় নবীন শিক্ষার্থীদের উৎসবমুখর পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। হলে এসে নিজেদের সিটে উঠতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। শেখ হাসিনা হলে সিট বরাদ্দ পাওয়া শিক্ষার্থী নাবিলা বিনতে হারুন বলেন, আগামীকাল আমাদের ক্লাস শুরু হবে। তার ঠিক এক দিন আগেই আমরা হলে উঠতে পারলাম। গণরুম জটিলতা, র‍্যাগিং নিয়ে ভয় বা সংশয় থাকলেও এর কিছুই পাইনি। আমরা নির্ধারিত এলোটেড হলে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনো ঝামেলা ছাড়াই সিটে উঠতে পেরেছি। পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসার কষ্ট থাকলেও নতুন নতুন সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভালো লাগছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ অনুভূতি, যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ চারপাশে।

নতুন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রথম দিন এসেই সিটে উঠতে পারায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা নবীনদের শুভকামনা জানিয়ে নিজেদের অনুভূতি জানাচ্ছেন। ৫০ ব্যাচের শিক্ষার্থী নিবিড় ভূইয়া বলেন, ৫৩তম আবর্তন (ব্যাচ) কতটা লাকি হলে, তাদের বস্তাপচা গণরুম দেখতে হয়নি, সহ্য করতে হবে না ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের দাপট, করতে হবে না মিছিল-মিটিং কিংবা বড়ভাইদের চাটুকারিতা। এ যেন যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ চাইতাম, কিঞ্চিৎ হলেও সেইরকমই।

প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ৫৩ ব্যাচকে হলে উঠানোর মধ্য দিয়ে একটি নতুন মাইলফলক তৈরি হলো। বহুবছর ধরে যে গণরুমের সংস্কৃতি ছিল আমরা এবার তা পুরোপুরি বন্ধ করতে পেরেছি। প্রতিটি শিক্ষার্থী হলে উঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের সিটে উঠতে পেরেছে। প্রতিটি রুমেই শিক্ষার্থীরা তাদের বেড, চেয়ার ও টেবিল পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীদের এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে আমরা বিভিন্ন দায়িত্ব পেয়েছি। তাদের জন্য শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এরই মধ্যে গণরুম বিলুপ্ত করে র‌্যাগিং ও মাদক নির্মূলে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আশা করছি সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close