প্রদীপ রায় জিতু, বীরগঞ্জ (দিনাজপুর)
আদিবাসীদের ২০০ বছরের ঐতিহ্য
পছন্দের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার মেলা
সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীর নজর কাড়তে তরুণীরা সেজেছেন বর্ণিল পোশাকে। খোঁপায় বাহারি ফুলের সাজ। তরুণরাও এসেছেন হাতে রুমাল বেঁধে। রুমালই জানিয়ে দিচ্ছে, এসব তরুণও খুঁজছেন স্বপ্নময় যৌথ জীবনের পথচলার সঙ্গী। পরস্পরকে পছন্দ করলেই গাঁটছড়া বাঁধার পালা।
গত মঙ্গলবার দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠিত হলো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ঐতিহ্যবাহী মিলনমেলা। মেলায় ভিড় জমিয়েছে অনেকেই। পছন্দের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া যায় এ মেলা থেকে। এ মেলা স্থানীয়দের কাছে বাসিয়াহাটি নামেও পরিচিত। প্রতি বছর শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রতিমা বিসর্জনের পরের দিন মেলাটি অনুষ্ঠিত হয় বলেই এ নাম। বাসি থেকে বাসিয়া। তবে এ বছর মেলা অনুষ্ঠিত হলো আরো এক দিন পরে। মেলায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার; বিশেষ করে সাঁওতাল তরুণ-তরুণীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা বয়সের মানুষ জড়ো হয়েছিল। দিনাজপুর ছাড়াও ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার আদিবাসীরা দুয়েক দিন আগে থেকেই স্থানীয় আত্মীয়-স্বজনের বাসায় হাজির হয়েছিলেন।
কালের বিবর্তনে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার রীতিনীতিতে পরিবর্তন এলেও মেলায় আসা বেশিরভাগ তরুণীর সাজগোজ অতীত ঐতিহ্যই মনে করিয়ে দিয়েছে। কপালে টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক, চুলের বেণীতে ফুলের মালায় সেজেছিলো তরুণীরা। এ বিষয়ে আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সদস্য দুলাল হাঁসদা বলেন, ‘গতবারের মেলায় আমাদের বীরগঞ্জ উপজেলার চকবানারশি গ্রামে রামনাথ মার্ডির ছেলে শান্ত মার্ডির সঙ্গে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার রামপুর গ্রামের বাবুরাম বেসরার মেয়ে শান্তি বেসরার দেখাদেখি হয়। সেদিনের সেই পছন্দ থেকে তিন মাস পর পারিবারিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।’ স্থানীয়রা জানান, মেলার বিশেষ আকর্ষণই হলো তরুণ তরুণীরা এখান থেকে পছন্দের পাত্রপাত্রী খুঁজে নিতে পারেন। এখানে কোনো পাত্র বা পাত্রী পরস্পরকে পছন্দ করলে পরিবারের আলোচনার মাধ্যমে ধুমধামে বিয়ে দেওয়া হয়। এদের বেশির ভাগের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
মেলায় সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সব বয়সি নারী-পুরুষের ভিড়। বাহারি সব কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, লিপস্টিক, কানের দুল, ঝিনুক ও মাটির তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও খাবারের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। মেলার এক পাশে চলছে ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানের আসর। কাহারোল উপজেলা থেকে আসা লিটন মার্ডী জানান, একসময় এ মেলায় প্রেমের গল্পের ফুল ফোটার জন্য বিশেষ পরিচিতি ছিল। অনেকেই এখানে এসে তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতেন। সেই সময়ের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাগুলো এখনো অনেকের মনে গেঁথে আছে। তবে মেলার মধ্যেও এখনো কিছু যুবক-যুবতী নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন, যদিও তা আগের মতো ব্যাপক নয়।
মেলার আয়োজক কমিটির পক্ষে বীরগঞ্জ থানা আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সভাপতি শীতল মার্ডী বলেন, ‘গোপালগঞ্জ আদিবাসী মিলনমেলাটি ২০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ মেলা বিজয়া দশমীর পরের দিনে অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নানা বয়সের মানুষজন আসেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা মেলায় পছন্দের জীবনসঙ্গীকে পছন্দ করতে পারেন। পরে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলা চলমান। আমরা শুধু এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি।’ নিজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান আনিস বলেন, ‘মিলনমেলাটি ২০০ বছরের পুরোনো। এ ঐতিহ্যবাহী মেলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে, এমনকি পাশের দেশ ভারত থেকেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ আসেন। এ মেলার বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা একে অপরকে পছন্দ কওে বিয়ে করতে পারেন। মেলায় প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।’
মেলার প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সমাজসেবক এবং কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সদস্য আলহাজ মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘এ মেলা পুরোনো আমল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এর মাধ্যমে আমাদের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দেশবাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। মেলার আয়োজন সবসময়ই একটি বিশেষ নন্দিত ব্যাপার। তবে এ বছর আর্থিক সংকটের কারণে মেলা আয়োজন নিয়ে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সবার সহযোগিতায় মেলাটি আনন্দমুখর ও বর্ণিলভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ তিনি আরো জানান, এ ধরনের মেলা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করে। মেলার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে একাত্মতা তৈরি হয়, যা আদিবাসী সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
"