প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
গণ-অভ্যুত্থানগাথা
জুতা দেখে শনাক্ত মাদরাসাছাত্র ছায়াদের লাশ
বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তায় ধোঁয়ার কুণ্ডুলী দেখে খেলা ফেলে দেখতে গিয়েছিল ছোট্ট ছায়াদ। তাই নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন বাবা-মা ও শিক্ষক। শেষ পর্যন্ত তাদের উৎকণ্ঠাই সত্যি হলো। প্রতিবেশীর মোবাইলে তোলা ছবিতে পায়ের জুতা দেখে মা-বাবা শনাক্ত করলেন ছেলের লাশ।
সাভারের চাপাইন এলাকার জাবাল-ই-নূর দাখিল মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছায়াদ মাহমুদ খান (১২)। খবর বাসসের।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ধল্লা, খানপাড়ার বাহাদুর খান (৪০) ও মা হালিমা আক্তার (৩৯)-এর একমাত্র পুত্র ছায়াদ। তারা সাভার পৌরসভার চাপাইন সড়কের শাহীবাগের আলমগীর মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া। খান বাহাদুর দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী। এ ঘটনার কিছুদিন আগেই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে দেশে আসেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে ছায়াদ দ্বিতীয়। বড় বোন তাসলিমা খানম নাজনীন (২০) ও ছোট বোন আফরোজা খানম নুসরাত (১০)।
ছায়াদের মা হালিমা আক্তার বাসসকে বলেন, ২০ জুলাই আমার ছেলে বাসার ছাদেই তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল। বাইরে গোলাগুলির শব্দ শুনে ছুটে যায় দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পরই ওদের মাদরাসার শিক্ষক মো. ইব্রাহিম আমাকে ফোনে জানান, এখানে গোলাগুলি হচ্ছে, ছায়াদ কি বাসায় ফিরেছে? এর কিছুক্ষণ পর আবারও ওই শিক্ষক ফোনে জানতে চান, এখানে মাদরাসার এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছে, ছায়াদ কি বাসায় ফিরেছে? তখন আমি ওর বাবাকে ছায়াদের বাসায় না ফেরার খবর জানাই। ওর বাবা বাসায় ফিরে আসেন। আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করতে থাকি। এর কিছুক্ষণ পর মোবাইলে ছবি দেখে জানতে পারি ছায়াদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
ছায়াদের বাবা বাহাদুর খান বাসসকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ২০ জুলাই ছায়াদের মাদরাসা বন্ধ থাকায় বাড়িতেই ছিল সে। বাবা-ছেলে একসঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খেয়েছি। দুপুরের খাওয়া শেষে ছায়াদ ওর বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির ছাদে যায় খেলতে। এর কিছুক্ষণ পর আমিও মেয়ের জন্য ওষুধ কিনতে বাড়ির বাইরে যাই। তখন সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। এ সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নিউমার্কেটের সামনের ওভারব্রিজে ধোঁয়ার কুণ্ডুলী দেখে তা দেখার জন্য বিকেল ৫টার দিকে বাড়ির ছাদে খেলতে থাকা ছায়াদ নিচে নেমে নিউমার্কেটের সামনে চলে যায়।
তিনি বলেন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে আমরা ছায়াদকে খুঁজতে শুরু করি। এ সময় আমি স্থানীয় একটি মসজিদের সামনে দাঁড়াই, যাতে ও নামাজ পড়তে গেলে বের হওয়ার সময় দেখতে পাই। এ সময় বিভিন্নজনকে ছায়াদের কথা জিজ্ঞেস করে খোঁজ করতে থাকি। তখন এক ব্যক্তি তার মোবাইল ফোনে তোলা একটি ছেলের গুলিবিদ্ধ ছবি দেখায়, যেখানে শুধু ওর পা আর পায়ের জুতো দেখা যাচ্ছিল। তখন আমি আর আমার স্ত্রী চিনতে পারি এটা আমাদের ছেলের জুতো। জানতে পারি ও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর নিয়ে পাশের শাহীবাগের প্রজন্ম স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখান থেকে হাসপাতালের লোকজন আমাদের জানায়, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি ছেলেকে এখানে নিয়ে এসেছিল স্থানীয়রা। তবে অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে আমরা সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছি। তখন আমি এনাম হাসপাতালের পাশেই থাকা আমার ভাগনে নাহিদকে ছায়াদ মাহমুদের গুলিবিদ্ধের খবর দিয়ে ওর চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে বলি। আমি আর আমার স্ত্রীও দ্রুত এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পাই সেখানকার বারান্দায় আমার ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। চিকিৎসক জানান, পায়ের ওপরের অংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ছায়াদ মারা গেছে।
একমাত্র ছেলের এমন মৃত্যুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন ছায়াদের বাবা-মা। ছায়াদের বাবা বাহাদুর খান শুধুই ছেলের স্মৃতিচারণ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।
ছায়াদের বড় বোন তাসলিমা খানম নাজনীন বাসসকে বলেন, ছায়াদ মাহমুদ ছিল অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র স্বভাবের। মাদরাসায় পড়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ও ছিল অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। আমাদের অনেক আদরের ছিল ভাইটি। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে আমাদের পুরো পরিবার আজ শোকে মুহ্যমান। আমার ছোট্ট আদরের ভাইকে কীভাবে ভুলে থাকব?
ছায়াদের শিক্ষক জাবাল-ই-নূর দাখিল মাদরাসার সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. ইব্রাহীম বাসসকে জানান, আমি ছায়াদ খানের দুটি ক্লাস নিতাম। ওর মতো ভদ্র আর শান্তশিষ্ট স্বভাবের কোনো ছাত্রই হয় না। শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান করত। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত। পড়াশোনায় মোটামুটি হলেও আদব-কায়দার দিক থেকে ছায়াদ খান মাহমুদ ছিল অনেক ভালো। ওর মতো শিক্ষার্থী হারিয়ে আমরা সবাই শোকাহত।
হালিমা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটি ছিল অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। ফুটবল খেলার প্রতি ছিল ওর ঝোঁক। পড়াশোনায়ও ছিল অত্যন্ত ভালো। ছায়াদদের মৃত্যু কখনো বৃথা যেতে পারে না, সমাজ থেকে বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমেই ছায়াদরা জায়গা করে নেবে মানুষের অন্তরে।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানায়, জাবাল-ই-নূর মাদরাসা থেকে ছায়াদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক বা সরকারি সহযোগিতা তারা পাননি।
"