শেরপুর প্রতিনিধি
কৃষি খাতেই ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের পাঁচ উপজেলায় সৃষ্ট বন্যার ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। পাহাড়ি নদী মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেল্লাখালীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি নেমে যাওয়ার পর জেলার ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী, শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। বন্যায় খেতের ফসল ডুবে নষ্ট হওয়া কৃষক পরিবারগুলো দিশাহারা। অনেক স্থান এখনো জলাবদ্ধ থাকায় পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা যাচ্ছে না। তবে এ বন্যায় শুধু কৃষি খাতেই ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হওয়ার ধারণা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. সুকল্প দাস।
সুকল্প দাস বলেন, এবারের বন্যায় শেরপুর জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮০ জন কৃষক। এ বছর ৯৫ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়েছিল। তার মধ্যে ৩৭ হাজার ১৫৫ হেক্টরই বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৫৯ হেক্টর জমির শাকসবজি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২ দশমিক ৭ হেক্টর জমির বস্তায় আদা চাষ আক্রান্ত হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে সুকল্প দাস বলেন, এখনো অনেক জায়গায় বন্যার পানি আছে। যার কারণে ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পানি নেমে গেলেই বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ফসল নষ্ট হওয়ায় দিশাহারা কৃষকরা বলছেন, ১৯৮৮ সালের পর এত ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েননি তারা। তাদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। এখনই পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিলে তাদের পথে বসতে হবে।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের কৃষক সামাদ মিয়া বলেন, এ বছর ৩০ বিঘা জমিতে আমনের চাষ করেছিলাম। বন্যায় সব ভেসে গেছে। খেতের একটা ধানও তুলতে পারবো না। ধার-কর্য করে আবাদ করেছিলাম, সামনে কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। নলিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও-বাতকুচি এলাকায় বন্যায় ধসে পড়েছে বাড়িঘর। নলিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাঁও-বাতকুচি এলাকায় বন্যায় ধসে পড়েছে বাড়িঘর। ঝিনাইগাতী উপজেলার কুশাইকুড়া গ্রামের কৃষক আবদুল খালেকের প্রায় ৭ একর এবং আবদুল মালেকের ৪ একর জমি ধানসহ ঢলের পানিতে আসা বালুতে ঢেকে নষ্ট হয়ে গেছে।
একই অবস্থা দড়িকালীনগর গ্রামের রমিজ মিয়ারও। তিনি বলেন, ৮৮ সালের পর এত ভয়াবহ বন্যা আমরা কখনো দেখিনি। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ৫০ বিঘা জমিতে আবাদ করেছিলাম। বন্যার কারণে এখন আমি সর্বস্বান্ত।
শেরপুর সদর উপজেলার লছমনপুর এলাকার কৃষক ফরিদ বলেন, আগাম সবজির আবাদ করছিলাম। প্রায় লাখ খানেক টাকা খরচ করেও খেতের সবজি থেকে এক টাকাও আয় হলো না।
এদিকে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান জানান, নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর পানি কমে নালিতাবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং নাকগাঁও পয়েন্টে ৪২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চেল্লাখালী নদীর পানি কমে বিপৎসীমার ১০৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়লেও তা বিপৎসীমার ৫১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উজান থেকে ঢলের পানি নেমে গেলেও ভাটি এলাকায় নিম্নাঞ্চলে অনেক ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটে এখনো পানি জমে থাকায় মানুষের দুর্ভোগ কাটেনি। অনেক এলাকায় দিগন্ত জুড়ে ফসলের মাঠ এখনো পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার বাতকুচি গ্রামের আবদুর রাজ্জাক, সাজেদুল ইসলাম ও হামেদুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি না থাকায় ঘরবাড়ি থেকে ঢলের পানি নেমে গেছে। এমনকি চেল্লাখালী নদীর পানিও কমে গেছে। তবে ভাটির দিকে মানুষের ঘরবাড়ির চারপাশের পানি এখনো সরেনি। গ্রামের লোকজনের বাড়ির বাইরে চলাচলের জন্য কলার ভেলা অথবা কাপড় ভিজিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ওইসব এলাকায় নৌকায় করে অনেকেই ত্রাণ দিয়ে গেছেন। এতে পানিবন্দি মানুষের উপকার হয়েছে। তবে যেসব গ্রামের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের দ্রুত স্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও মেরামত করে পুনর্বাসন করা প্রয়োজন বলে তাগিদ দেন তারা।
এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় গতকাল সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, বৃষ্টি না হওয়ার কারণে বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হলেও সেখানের পানিও কমতে শুরু করেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা চলমান রয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের বলা হয়েছে। পানি পুরোপুরি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার পর পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া বন্যায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ ও সংস্কার করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে ঢেউটিন ও নগদ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
"