ছায়েদ আহমেদ, হাতিয়া (নোয়াখালী)
হাতিয়ায় শিক্ষা কর্মকর্তার অনিয়ম ও ঘুষ গ্রহণ
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ জব্বার ঘুষ গ্রহণ করে সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম নুরেজ্জামানের হাজিরা খাতায় জালিয়াতি করে ছুটি লিখে অনিয়ম করেছেন। এ রকম অনিয়ম করে শিক্ষকদের বেতনের টাকা আত্মসাৎসহ অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুস জব্বার হাতিয়াতে যোগদানের পর থেকেই তিনি এসব অনিয়ম করে আসছেন। তার অনিয়মের সহযোগী- উচ্চমান সহকারী কাম-হিসাবরক্ষক (ইউডিএ) নাজিম উদ্দিন। এখানে যোগদানের পর থেকে উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম প্রহরী (আউটসোর্সিং) পদে নিয়োজিত ৯৭ জন কর্মচারীর বেতন বিল মাস শেষে উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠানোর কথা থাকলেও পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের পরও পাঠানো হয় না বলে অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী কর্মচারীরা। তারা জানান, সেপ্টেম্বর মাসের ২৬ তারিখ পার হয়ে গেলেও আগস্ট মাসের বেতন ভাতাদি এখনো তারা পাননি। বেতন সংক্রান্তে আমরা অফিসে গেলে আমাদের মানুষের মতো আচরণ করা হয় না, অফিসের নানান জটিলতা দেখিয়ে নাজিম উদ্দিন আমাদের হয়রানি করেন।
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার প্রায় ৬০০ শিক্ষকের নিম্নধাপ থেকে উচ্চধাপে বেতন নির্ধারণসহ বকেয়া বিল প্রদানের ক্ষেত্রে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, আবদুস জব্বার, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম নুরেজ্জমান, উচ্চমান সহকারী কাম-হিসাবরক্ষক (ইউডিএ.) নাজিম উদ্দিন শিক্ষা অফিসের জন্য ঘুষ আদায়ের কাজে নিয়োজিত এজেন্ট সহকারী শিক্ষক এনায়েতে রাব্বীর বিরুদ্ধে কোটি টাকা ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে কয়েকটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ওইসব প্রতিবেদনে শিক্ষকদের মন্তব্যের জন্য ডাকা হয়। ওই শিক্ষকদের অফিস কক্ষে একজন করে ডেকে এনে শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুস জব্বার ও ইউডিএ, নাজিম উদ্দিন নানা কৌশলে ম্যানেজ করে- মন্তব্যের বিপরীতে অভিযুক্তদের পক্ষে লিখিত নেওয়ার চেষ্টা করাসহ বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করেছে। যা অনিয়মগুলোকে ঢাকা দেওয়ার অপপ্রয়াস।
সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম নুরেজ্জমান হাতিয়াতে যোগদানের পর থেকে প্রায়ই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে ক্ষেত্রবিশেষ সিএল, ছুটি গ্রহণসহ নানাবিধ অনিয়ম করে আসছেন। বর্তমান শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুস জব্বারের যোগদানের পর থেকে তার অনিয়মের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি৪) আওতায় হাতিয়া উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নবনিয়োগপ্রাপ্ত ১৬ জন সহকারী শিক্ষকের ১৫ দিনব্যাপী প্রাক-প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পঞ্চম ব্যাচের প্রশিক্ষণ ১৮ এপ্রিল হয়। উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের (ইউআরসি) ইনস্ট্রাক্টর আকবর হোসেন ও সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম নুরেজ্জমান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২৫ এপ্রিল ছিল প্রশিক্ষণের অষ্টম দিন বৃহস্পতিবার। প্রশিক্ষক এ বি এম নুরেজ্জমান এ দিন সকালে হাজিরায় স্বাক্ষর করে কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে কর্মস্থল ত্যাগ করে নিজ বাড়িতে চলে যান। পরদিন (২৬ এপ্রিল) থেকে প্রশিক্ষণের ১৩ তম দিন (৩০ এপ্রিল) পর্যন্ত ৫দিন প্রশিক্ষণে অনুপস্থিত থেকেন। ২ মে থেকে প্রাক-প্রাথমিক প্রশিক্ষণের শেষ হওয়ার পরের দিন ৪ মে পর্যন্ত ৩ দিন সুপারিনটেনডেন্ট মাইজদী পিটিআই নোয়াখালীর তিনি পরিমার্জিত ডিপিএড (বিটিপিটি) কার্যক্রমের মনিটরিং, মেন্টারিং ও মূল্যায়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে মাইজদী পিটিআইতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ইউআরসির প্রাক-প্রাথমিক প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি গোপন রেখে মাইজদী পিটিআই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। সেই সঙ্গে উভয় জায়গা থেকে অবৈধভাবে প্রশিক্ষকের ও প্রশিক্ষণার্থীর পুরো ব্যাচের সম্মানী ভাতা উত্তোলন করেন। প্রশিক্ষক নুরেজ্জমান প্রাক প্রাথমিক প্রশিক্ষণের উপস্থিতি না দিয়ে তিনি প্রশিক্ষণের হাজিরা খাতা খালি রেখে দেন। দুই জায়গা থেকে পুরো প্রশিক্ষণ ভাতার টাকা নেওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি এমনটা করেছেন। প্রাক-প্রাথমিক প্রশিক্ষণে ১ হাজার ২০০ টাকা উৎস কর কর্তন পূর্বক ১৫ দিনের প্রশিক্ষকের ভাতা বাবদ ১৫ হাজার টাকা ও মাইজদী পিটিআইতে ৩ দিনের প্রশিক্ষণে খরচাদী বাবদ ৭২০ টাকা কর্তন পূর্বক ৮ হাজার ৮৭০ টাকা উঠিয়ে নেন।
আরো জানা যায়, শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ জব্বারকে ঘুষ হিসেবে মাসোয়ারা দিয়ে বেশির ভাগ সময় শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম নুরেজ্জমান কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে নিজ বাড়িতে থাকেন। তবে এরই মধ্যে গত মে মাস থেকে কিছুদিন শিক্ষকদের ঘিরে অবৈধ ভাগবাটোয়ারা নিয়ে এই শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও বর্তমানে তাদের উভয়ের যোগসাজশে হাতিয়া শিক্ষা অফিসে অনিয়ম চলে আসছে।
সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুজ্জমান প্রায়ই বৃহস্পতিবার সকালে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে কর্তৃপক্ষের বিনানুমতিতে কর্মস্থল ত্যাগ করে একই জেলার কবিরহাট উপজেলায় তার নিজ বাড়িতে চলে যান। গত শুক্রবার-শনিবার নিজ বাড়িতে সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ শেষে খোলার দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। মঙ্গলবার ২৮ মে, কর্মস্থলে এসে এই দিনের হাজিরা দিলেও শিক্ষা কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বের জেরে এবার আর আগের মতো নুরেজ্জমানের পেছনের তারিখের অনুপস্থিত দুই দিনের স্বাক্ষর দেওয়ার সুযোগ হয়নি। ফলে ওই দুই দিনের ঘরে শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুস জব্বার- নুরেজ্জমানের হাজিরা খাতায় লাল কালি দিয়ে অনুপস্থিত মার্ক করেন। এভাবে একাধিকবার এ অনিয়ম চলে। এরই মধ্যে শিক্ষা কর্মকর্তারা নিজেদের দ্বন্দ্বের অবসান করলে আবদুস জব্বার নগদ টাকা ঘুষ নিয়ে নিয়মবহির্ভূত পেছনের তারিখ দিয়ে অনুপস্থিত দিনের নৈমিত্তিক ছুটি প্রদান করে হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতিকে মুছে সিএল ছুটি লিখে দেন। এমনকি প্রতি মাস শেষে এ বি এম নুরেজ্জমানকে পুরো মাসের বেতন ভাতাদি দিয়ে থাকেন।
সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম নুরুজ্জমান নৈমিত্তিক ছুটির বিষয়টি স্বীকার করলেও বাকি অভিযোগ সম্পর্কে তার জানা নাই বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুস জব্বার জানান, নুরুজ্জমান সাহেব ওই সময় চরের স্কুলগুলোয় ভিজিটে থাকতে পারেন। প্রাথমিক শিক্ষার চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক ড. মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি জানান, যাদের বিরুদ্ধেই হোক, লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
"