ইমাম হোসেন হিমেল, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
রাখাইনদের ঘর ভেঙে উঠছে বহুতল ভবন
অস্তিত্ব সংকটে কুয়াকাটা কেরানীপাড়া * হুমকির মুখে পড়েছে ২৩০ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য
পটুয়াখালীর পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় রাখাইনদের মগন সম্পত্তিতে সরকারের দেওয়া প্রণোদনার ঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই নির্মাণকাজ চলছে একাধিক বহুতল ভবনের। এতে হুমকির মুখে পড়েছে কুয়াকাটার অলংকার খ্যাত রাখাইন ভাষা-শিক্ষাসহ ২৩০ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৩০ বছর আগে আদিবাসী রাখাইনদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পৃক্ত কুয়াকাটা কেরানীপাড়া। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় পর্যটকদের কাছে বিশেষ এক আকর্ষণ রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবন চিত্র। ১৭৯৪ সালে প্রায় ১ লাখের বেশি রাখাইনরা আগমন করেন পটুয়াখালীর উপকূল অঞ্চলে। সমুদ্র উপকূল কেন্দ্রিক বনাঞ্চল সাফ করে হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেতে টঙ্গের ঘর নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। বণ্যপ্রাণীর সঙ্গে জীবন বাজি রেখে বেড়ে ওঠা এই রাখাইন জাতি-গোষ্ঠী কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের জঙ্গল কেটে প্রথমে আবাদি জমির আত্মপ্রকাশ করেন বলে তাদের দাবি। তবে বর্তমানে কুয়াকাটা উপকূল এলাকার পার্শ্ববর্তী অন্য পাড়াগুলোর আদি বসতিতে কিছুটা আধুনিকতার ছোয়া লাগলেও কুয়াকাটা কেরানীপাড়া এখন পুরোপুরিভাবে দূরে সরে যাচ্ছে তাদের আদি সংস্কৃতি টংয়ের ঘর থেকে। অনুমোদনবিহীনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে কেরানীপাড়ায় অসংখ্য বহুতল বাণিজ্যিক ভবন।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সরকারের সময় কেরানীপাড়ায় রাখাইনদের উন্নত জীবন ব্যবস্থায় দেওয়া হয় প্রণোদনার টংয়ের ঘর। এসব ঘর ভেঙে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণকাজ। যেসব ঘরগুলো এখনো দৃশ্যমান রয়েছে সেগুলোকে ভেঙে পরিকল্পনা রয়েছে বহুতল ভবন নির্মাণের। অচিরেই কুয়াকাটায় রাখাইনদের অস্তিত্ব বিলীনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাখাইন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সররকারের তরফ থেকে যেখানে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ, সেখানে শেয়ারের নামে নির্মাণযজ্ঞ চলছে অসংখ্য বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। রাখাইনদের একাংশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
রাখাইনদের অভিযোগ, কালের বিবর্তনে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে এখন মাত্র কয়েক হাজার রাখাইন এ অঞ্চলে টিকে আছে। যেসব রাখাইনরা বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করছেন তারাও নানামুখী হুমকির মধ্যে রয়েছে। অনেকেই এরইমধ্যে বাধ্য হয়েছে কুয়াকাটা উপকূল অঞ্চল ছেরে যেতে।
কুয়াকাটা কেরানীপাড়ার রাখাইনদের ভাষ্য মতে, কেরানীপাড়ার আওতাধীন থাকা জমির দখল নিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা কয়েকজন অতিলোভী রাখাইনদের সঙ্গে মিলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ২৩০ বছরের কৃষ্টি কালচার, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ঘেরা; কালের সাক্ষী বহন করা কুয়াকাটার রাখাইন সম্প্রদায়সহ কেরানীপাড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারা আরো বলেছেন, যে এ পাড়ায় প্রতিনিয়ত শত শত পর্যটক দর্শন করতে আসেন। এই কেরানীপাড়া বিলুপ্ত হলে পর্যটনমুখী কুয়াকাটাপ্রেমী আগত দর্শনার্থীরা আর দেখতে পাবে না রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবন চিত্র এবং আদি নিদর্শন।
রাখাইনরা কেন দূরে সরে যাচ্ছে তাদের আদি সংস্কৃতি থেকে এমন বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় রাখাইন মংওয়েং (৬৪) বলেন, বর্তমানে এ পাড়া থেকে রাখাইনদের বিতাড়িত করার জন্য বিভিন্ন কৌশলে একটি প্রভাবশালী চক্র তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশেষ করে কুয়াকাটার প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় জমির গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এসব জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা আত্মসাৎ করার জন্য কয়েকজন অতিলোভী রাখাইনদের ফাদে ফেলা হচ্ছে। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে সরকারের দেওয়া প্রণোদনার ঘরগুলোকে ভেঙে একেরপর এক বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে এসব বিনিয়োগকারী মগন সম্পত্তিতে তোলা বহুতল ভবনের বিনিময়ে কিছু টাকা দিয়ে রাখাইনদের এই পাড়া থেকে বিতাড়িত করবে এমন আশঙ্কা রয়েছে। তবে আমাদের মগন সম্পত্তিতে পাড়া প্রধান এবং পাড়ার সবার সমন্বিত পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার বিধান না থাকলেও এসব বহুতল ভবন তোলা হচ্ছে। আমাদের রাখাইনদের এসব আদি নিদর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা এখন অতিলোভী কতিপয় রাখাইনদের কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে।
এ বিষয়ে কেরানীপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন কর্মী লুমা মগনী আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, পাড়ার এ জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একের পর এক বহুতল ভবন উঠছে। তবে আমাদের পাড়ার সম্পত্তিতে অনেক প্রভাবশালীরা ভুয়া কাগজ বানিয়ে এমনকি নিজস্ব জমিতেও গেড়ে বসেছে। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কুয়াকাটা কেরানীপাড়ার আদিবাসী রাখাইনদের অস্তিত্ব রক্ষার দাবি জানান তিনি।
এবিষয়ে কেরানীপাড়ার রাখাইন নেতা উচাচিং মাতুব্বর বলেন, রাখাইনদের আগে ওই অঞ্চলে কোনো ধর্মের লোকজন আসার নজির নেই। বর্তমানে হাতেগোনা কিছু রাখাইন থাকলেও তাও এখন নানা জটিলতায় জর্জরিত। কুয়াকাটা উপকূলের ওই এলাকার সম্পত্তি একসময় রাখাইনদের মালিকানায় থাকলেও এখন মাত্র সামান্য জমির আওতায় কেরানীপাড়া দৃশ্যমান রয়েছে। তবে আমাদের বিধানে বহুতল ভবন নির্মাণের সুযোগ না থাকলেও রুটি-রুজির তাগিদে বাধ্য হচ্ছি।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, কুয়াকাটা রাখাইন অধ্যুষিত একটি এলাকা কেরানীপাড়া। রাখাইনদের এ আদি বসতি এটি পর্যটকদের জন্য এবং পর্যটন শিল্পের জন্য একটি ব্যতিক্রমী সংস্কৃতি জীবনধারা ছিল। সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করতে পারছি যে, ওই পাড়ার রাখাইনদের যে জমি এগুলো বিধি বহির্ভূতভাবে চুক্তি করে আমাদের উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন কিংবা বিভাগীয় প্রশাসনের কোনোরূপ অনুমতি না নিয়ে সেখানে বহুতল ভবনের প্রক্রিয়া চলমান আছে। তার প্রেক্ষিতে এরইমধ্যে আমরা দুটি নোটিস দিয়েছে। যার একটি গত চার মাস ও অপরটি তিন মাস আগে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ডকুমেন্টস, অনুমতি এবং সেখানে বহুতল ভবন কিংবা হোটেল মোটেল করার অনুমতি আছে কিনা তা সাবমিট করার জন্য তাদের নোটিসে বলা হয়েছে।
"