চাঁদপুর প্রতিনিধি
বীরগাথা
মায়ের সঙ্গে শহীদ হওয়ার গল্প বলতেন খোবাইব
১১ ভাইবোনের মধ্যে খোয়াইব ছিল সবার ছোট। পরিবারে আদরের সন্তান
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার উজানি গ্রামের দেওয়ান বাড়ির মাওলানা আবদুর রহমানের ছেলে মো. খোবাইব (২১)। বাবার সঙ্গেই থাকতেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর পাশে কাদলার পাড় এলাকায় নিজেদের মাদরাশা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেলে যাত্রাবাড়ী ওভার ব্রিজের উত্তর পাশে হেঁটে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন খোয়াইব। ‘আন্দোলন চলাকালীন মায়ের সঙ্গে গল্প করে বলতেন আমার নাম কেন খোবাইব রেখেছ। এই নাম তো একজন শহীদ সাহাবির নাম। তাহলেও আমিও শহীদ হব।’ শেষ পর্যন্ত তিনি শহীদ হলেন।
সম্প্রতি খোবাইবের পৈতৃক বাড়িতে গেলে তার পরিবারের সদস্যদের না পেয়ে তার বাবা মাওলানা আবদুর রহমানের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি এসব তথ্য জানান। ছেলের বিষয়ে জানতে চাইলে ৭৩ বছর বয়সি এই বাবা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ছেলে আমার এই বছরেই দাওরাহ সম্পন্ন করেছে। আমাদের নিজস্ব মাদরাসাই শিক্ষার্থীদের পড়াতে শুরু করেন। আমার ৫ ছেলের মধ্যেই খোবাইব হচ্ছে সবার ছোট। পরিবারের সবাই তাকে খুবই আদর করত। তার সব আবদার ও নিজের মনের কথা মায়ের সঙ্গেই বলত।
শহীদ খোবাইবের বাবা মাওলানা আবদুর রহমান একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা। তিনি দেশের ঐতিহ্যবাহী চাঁদপুরের কচুয়া উজানি মাদরাসার শিক্ষা কর্মকর্তা। একই সঙ্গে যাত্রাবাড়ী এলাকার কাদলার পাড় জামেয়া ইসলামিয়া ইব্রাহিমিয়া ইছহাকিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা এবং মোহতামিম। খোবাইবের ছয় বোন এবং পাঁচ ভাই। ভাইদের মধ্যে সবার ছোট খোবাইব। বোনদের বিয়ে হয়েছে। ভাইরাও সবাই আলেম। বিভিন্ন স্থানে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত। খোবাইবের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে প্রধান ফটক তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। খুবই নিরিবিল বাড়ি। বাড়িতে লোকজন না থাকায় গাছের পাতা পড়ে স্তূপ হয়ে আছে বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয়রা জানান, দেওয়ান বাড়ির এই পরিবারের লোকজন খুবই ধার্মিক। এই বাড়ির নারীরা কারো সঙ্গে দেখা করেন না। পর্দা করে চলেন। তাদের বংশের সবাই খুবই ধার্মিক। তবে এলাকার সব শ্রেণি-পেশার লোকদের সঙ্গে তাদের রয়েছে সুসম্পর্ক। লোকজনও তাদের অনেক শ্রদ্ধা করে।
খোবাইবের বাবা মাওলানা আবদুর রহমান বাড়িতে এলে অধিকাংশ সময় স্থানীয় বাসিন্দা মো. শাহ জালালের সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চলাফেরা করেন। যে কারণে তার সঙ্গে খোবাইব পরিবারের সম্পর্ক খুবই ভালো। অটোরিকশাচালক শাহ জালাল বলেন, খোবাইব ছোটবেলায় উজানি মাদরাসায় পড়েছে। আমাদের সামনেই সে বড় হয়েছে। পরে তার বাবার সঙ্গে কাদলার পাড় মাদরাসায় চলে যায়। তার শহীদ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
খোবাইবের বাবা মাওলানা আবদুর রহমান বলেন, ছেলে সম্পর্কে আমি কী বলব। আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। তবে তার শহীদি তামান্নার কথা মায়ের কাছে বলত। মায়ের কাছে সব কথা বলত আমার ছেলে। তার শহীদ হওয়া সম্পর্কে বলেন, সারা দেশে যখন ছাত্রদের আন্দোলন তখন আমরা আমাদের মাদরাসার গেট আটকে রাখলে শিক্ষকরা আমাকে এসে অনুরোধ করে গেট খুলে দেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে সব শিক্ষার্থীই বিজয় মিছিলে যোগ দেয়। সবার অনুরোধে আমরা শিক্ষার্থীদের বিজয় মিছিলে যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দিই। তবে সবাই যেন একসঙ্গে না যায়, আলাদা করে যায় সে জন্য শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষর্থীরা মিছিলে যোগ দেয়। তবে খোবাইব কখন গেছে আমি জানতে পারিনি। কিছু সময় পর জানতে পেরেছি।
মাওলানা আবদুর রহমান বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে জানতে পারলাম খোবাইব যাত্রাবাড়ী ওভার ব্রিজের উত্তর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়। তার তলপেটে গুলি লাগে। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। সেখান থেকে লোকজন তাকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই খোবাইব আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে শহীদ হন। আমরা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে মাদরাসা নিয়ে আসি। মাদরাসায় জানাজা শেষে সেখানেই দাফন করা হয়।
"