সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

আমি মরে গেলে তুমি শহীদ মাতার সম্মান পাবে, মা!

মাকে বলা শহীদ সাদের শেষ কথা

‘মা তুমি চিন্তা করো না, আমি মরে গেলে তোমাকে বীরের মা বলে ডাকবে মানুষ, তুমি শহীদের মায়ের সম্মান পাবে। তোমাকে সবাই শ্রদ্ধা করবে’- ৫ আগস্ট দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা বাধা দিলে এ কথা বলে বেরিয়ে যান সাদ। এটাই মায়ের সঙ্গে সাদের শেষ কথা।

ঢাকার ধামরাই পৌরসভার কায়েতপাড়া নিবাসী শফিকুল ইসলাম ও আঞ্জুমান আরার ছেলে আফিকুল ইসলাম সাদ। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সাদ বড়। সাদের মা আঞ্জুমান আরা বাসস প্রতিবেদককে জানান, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা আঞ্জুমান আরার সাথেই শেষ কথা হয় আফিকুল ইসলাম সাদের। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে ২০ টাকা চায় সে। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েই বেরিয়ে পড়ে সাদ। তখন মা বারবার আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে বলে, ‘মা, তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না, আমার বন্ধুরাও তো গেছে, আমার কিছু হয়ে গেলে বা মরে গেলে তোমাকে সবাই শহীদের মা, বীরের মা বলবে।’ এর কিছুক্ষণ পরই সাভার উপজেলা ও থানার মধ্যবর্তী হার্ডিঞ্জ স্কুলের সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আফিকুল ইসলাম সাদ।

আঞ্জুমান আরা বলেন, সাদ বের হওয়ার পরপরই আমার ছোট ছেলে সাজিদুলও ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপরই কানে ভেসে আসে গোলাগুলির শব্দ। এলাকাবাসী বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় সাজিদুলকে।

সাজিদুলের কাছেই জানতে পারি সাদ আন্দোলনে গেছে। বারবার ফোনে খোঁজ নিচ্ছিলাম। দুপুরে পরপর দুবার কথাও হয়। তৃতীয়বার বিকেল ৩টার দিকে ফোন দিলে আর ফোন রিসিভ করে না। তখনই মনের ভেতর কেমন যেন করতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পর অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন আসে আমার কাছে। বলে, আন্টি আফিকুল তো মাথায় আঘাত পেয়েছে, ওকে আমরা সবাই স্থানীয় ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে আবারও ফোন দিয়ে বলে, এখানে রাখেনি, আমরা ওকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, আপনারা চলে আসুন। তখন আমরা সবাই দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে দেখি গুলিবিদ্ধ আমার ছেলে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তখন দ্রুত তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তৃতীয় দিন পর ৮ আগস্ট সকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সাদ। সাদের মৃত্যুতে থমকে গেছে একটি পরিবারের স্বপ্নও। আদরের সন্তানের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না শহীদ সাদের বাবা-মা।

জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই সাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদী বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে নিজের সমর্থনের কথা জানান দেন। ৪ আগস্ট ফেসবুকে পোস্ট করেন, ‘কুড বি এ নিউ রাইজ’। এরপর লেখেন, ‘যেই দেশের ইতিহাস রক্ত দিয়ে শুরু হয়েছে ওই ইতিহাস আবার লিখতে রক্তই লাগবে।’

সাদের বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোথা থেকে কী হয়ে গেল! আমি হতবাক। আমার পুরো পরিবারটি এলোমেলো হয়ে গেল। এ শোক কীভাবে কাটাব আমরা। তিনি বলেন, ৮ তারিখ সকালে যখন চিকিৎসকরা বলল সাদ আর নেই, তখন আমি সাদের সামনে গিয়ে ওকে তিনবার বাবা বাবা বলে ডাকি। কিন্তু আমার বাবা আর উঠল না। আমার ছেলেটা অত্যন্ত মেধাবী ছিল। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। চাকরির প্রতি আগ্রহ না থাকলেও বড় হয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন ছিল সাদের। একটি বুলেটে সবকিছুই শেষ হয়ে গেল।’

সাদের বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পড়ার টেবিল, বিছানা, খেলার ট্রফিগুলো শোভা পাচ্ছে ঘরের আনাচে-কানাচে। সবই আছে নেই শুধু সাদ। সকাল গড়িয়ে দুপুর, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, আজও যেন প্রতীক্ষায় বাবা-মা আর ভাই। তবু ফেরে না সাদ। ছেলেকে হারিয়ে অ্যালবামের ছবি, আলমারিতে রাখা খেলার ট্রফির মাঝেই মা আঞ্জুুমান আরা খুঁজে ফিরছেন নাড়ি ছেঁড়া ধন ছেলের স্মৃতি। সাদের অনুপস্থিতি মানতে পারছেন না বাবা শফিকুল ইসলাম কিংবা আদরের ছোট ভাই সাজিদুলও।

সাদের ছোট ভাই সাজিদুল বলেন, ‘সাদ আমার বড় ভাই হলেও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। আমাকে অনেক ভালোবাসত সে। যেকোনো কিছুই আমার সঙ্গে শেয়ার করত। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। কেন যে আমাকে সেদিন সঙ্গে নিল না, বুঝতে পারছি না। ভাইয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’ তিনি বলেন, যেদিন দেশ থেকে সত্যিকারের বৈষম্য দূর হবে, সেই দিনই সার্থক হবে আমার ভাইয়ের আত্মত্যাগ। সাদের প্রতিবেশী ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক নাজমুল হাসান অভি, ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনে নিহত ভাগ্নের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি সাদ অত্যন্ত ভালো ছেলে ছিল। সমাজের সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তার। তার ভালো ব্যবহারের জন্য মহল্লার সবাই তাকে স্নেহ করত। সাদের জন্য সবার কাছে দোয়া চান তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close