ভোলা প্রতিনিধি
ভোলার দৌলতখান
উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে দিশাহারা পরিবার
মো. রিয়াজের স্বপ্ন ছিল পরিবারের অভাব ঘুচানো * ছোট ভাইদের ঢাকায় এনে কর্মসংস্থান করা * সরকারের উচিত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো প্রতিবেশীর মন্তব্য
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান মো. রিয়াজকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন তার বাবা আবদুর রব। এদিকে দুই শিশুসন্তান নিয়ে অনিশ্চয়তা ও অর্থাভাবে দরিদ্র বাবার বাড়িতে ফিরে গেছেন রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা। অর্থসংকটে দুটি পরিবারে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নির্মাণশ্রমিক মো. রিয়াজ।
ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার চরখলিফা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড নিবাসী আবদুর রব ও রানু বেগমের সন্তান মো. রিয়াজ (২৫) ঢাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন। তার বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। মা গৃহবধূ। চার ভাইবোনের মধ্যে রিয়াজ দ্বিতীয়। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট দুই ভাইয়ের নাম আরিফ (১৪) ও সজিব (১২)। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন রিয়াজ। পরে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ নেন।
রিয়াজের উপার্জনেই চলত দুটি সংসার। তার অকালমৃত্যুতে অন্ধকার নেমে এসেছে শহীদ রিয়াজের বাবা আব্দুর রবের পরিবারে। বন্ধ হয়ে গেছে মাসিক আয়। এদিকে রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা দুই মেয়ে ফাতেমা (৭) এবং ফারিয়াকে (৪) নিয়ে চরম অর্থাভাবে দিন কাটাচ্ছেন বাবার সংসারে।
রিয়াজের বাবা আবদুর রব বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার তিন নম্বর গেট থেকে আমার ছেলের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। শুধু আমার ছেলে নয়, শত শত মায়ের বুক এভাবেই খালি হয়েছিল পুলিশের গুলিতে। আমার ছেলেসহ সব হত্যার বিচার চাই। এই ছেলের আয় ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র জীবিকার উৎস। একজন পঙ্গু অসহায় পিতা হিসেবে সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।’
রিয়াজের স্ত্রী ফারজানা মুঠোফোনে বলেন, ৫ আগস্ট সকাল পৌনে ৮টার দিকে আমার স্বামী ঘর থেকে বের হন। দুপুর ১২টার দিকে খবর পাই যাত্রাবাড়ী থানার তিন নম্বর গেটে আমার স্বামীর লাশ পড়ে আছে। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় লাশ উদ্ধার করে ভোলার দৌলতখানের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে পরদিন দাফন করা হয়। পরে জেনেছি পুলিশের গুলিতে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়।
তিনি জানান, তার স্বামী রিয়াজ আন্দোলনের শেষ দিকে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। ১ আগস্ট সর্বশেষ কাজে যান। তারপর আর কাজে যাননি। স্ত্রী নিষেধ করলেও তার কথা শুনতেন না। কারণ স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের অনেক অন্যায়-অবিচার তিনি মেনে নিতে পারতেন না। তাই যখন সরকার পতনের এক দফা দাবি এলো, তাতে পূর্ণ সমর্থন দেন রিয়াজ।
ফারজানা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী নিজের জীবনের কথা ভাবেননি। তিনি দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। তার মতো এমন হাজারো মানুষের আত্মত্যাগের জন্যই আমরা দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই সরকারের কাছে বলব, আমার স্বামী যেন শহিদী মর্যাদা পান।
যাত্রাবাড়ীর সাদ্দাম মার্কেট এলাকায় ছোট্ট একটি ভাড়া বাসায় ছিল দুই মেয়ে ফাতেমা ও ফারিয়াকে নিয়ে রিয়াজ-ফারজানার সুখের সংসার। রিয়াজ যা আয় করতেন, তা দিয়ে নিজেরা চলার পাশাপাশি মা-বাবার জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন। রিয়াজের মৃত্যুর পর টাকার অভাবে বাসা ছেড়ে দিয়ে বাবার বাসায় উঠেছেন ফারজানা। ফারজানার বাবা ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ীতে সবজি বিক্রি করেন। তার পরিবারেও নেই আর্থিক সচ্ছলতা। তার ওপর তিনজন মানুষের থাকাণ্ডখাওয়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন ফারজানার বাবা।
ফারজানা বলেন, ‘সরকার যদি আমাকে একটা ছোটখাটো চাকরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে মেয়েদের নিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম।’
শহীদ রিয়াজের মা রানু বেগম বলেন, ‘আমাদের সংসারে বড় ছেলে রিয়াজই ছিল আশার আলো। ছেলের মৃত্যুতে আমরা এখন অন্ধকার দেখছি। ছেলে প্রায়ই বলত মা-বাবাকে ঢাকা নিয়ে তার কাছে রাখবে। কিন্তু আমি যেতে চাইতাম না। কারণ ছেলের ছোট ঘর, খুব বেশি টাকাপয়সা নেই, আমরা গেলে বাড়তি খরচ হবে।’ তিনি বলেন, ছেলে রিয়াজের ইচ্ছে ছিল তার ছোট ভাইরা আরো একটু বড় হলে তাদের ঢাকায় নিয়ে কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। পরিবারের অভাব দূর হবে। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হলো না।
শহীদ রিয়াজের গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী নাছিমা বেগম জানান, রিয়াজদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা এমনিতেই অনেক খারাপ। তারপর এখন রিয়াজের মৃত্যুতে তারা আরো খারাপ অবস্থায় পড়েছেন। মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে তাদের চলতে হচ্ছে। তাই সরকার তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ালে তারা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবে।
"