ইসমাঈল সিরাজী
সংস্কৃতি
কাওয়ালিতে মাতোয়ারা তরুণ প্রজন্ম
‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’- জনপ্রিয় এই গানের সুরে মাতোয়ারা হাজারো শ্রোতা। গানের তালে সুরের মূর্চ্ছনায় তারুণ্যের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর মহাখালী ও তিতুমীর কলেজের আশপাশের এলাকা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে সরকারি তিতুমীর কলেজে গত সোমবার আয়োজন করা হয় কাওয়ালি সন্ধ্যার। শতাব্দী মঞ্চের আয়োজনে সংগঠনটির শিল্পীদের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে অংশ নেয় শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চ এবং জনপ্রিয় ‘কাসীদা’ ব্যান্ড। বিকেল ৫টায় কলেজ মুক্তমঞ্চে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় এ অনুষ্ঠান। কবিতা, কাওয়ালি ও বিদ্রোহী গানের অনুষ্ঠানটিতে নামে ছাত্র-জনতার ঢল। রাত ১০ পর্যন্ত চলে কাওয়ালির আসর। ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দর’, ‘দিল্লিতে খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া’সহ জনপ্রিয় কাওয়ালি গান গাওয়া হয় আয়োজনে।
হঠাৎ দেশজুড়ে কাওয়ালি সংগীতের আয়োজন অনুষ্ঠান চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। কাওয়ালি সংগীতে ঝুঁকছে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কাওয়ালি সন্ধ্যার আয়োজন হয়েছে, আরো কিছু কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর আফতাবনগরে অবস্থিত ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয়েছে কাওয়ালি আসরের।
তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে নানা বয়সি মানুষ ভিড় করছেন কাওয়ালি সন্ধ্যায়। আর সেজন্য কাওয়ালির ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহও বেড়েছে।
‘কাওয়ালি’ শব্দটির উৎপত্তি আরবি ‘কাওল’ বা ‘কাওলুন’ থেকে, যার অর্থ বাক্য। এর বহুবচন হলো ‘কাওয়ালি’, অর্থাৎ কথামালা বা বাক্যমালা। উপমহাদেশে এই আধ্যাত্মিক সংগীতকে ‘কাওয়ালি’ বলা হয়। কাওয়ালি গান একদল গায়ক বা সংগীতশিল্পী দ্বারা পরিবেশিত হয়। একজন প্রধান গায়ক, কোরাস দল ও যন্ত্রশিল্পীদের সমন্বয়ে দলগুলো গঠিত হয়। গান পরিবেশনের জন্য ব্যবহার হয় হারমোনিয়াম, তবলা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র।
প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ আমীর খসরু ‘কাওয়ালি’ ধারার সংগীতের প্রবর্তক বলে স্বীকৃত। তিনিই কাওয়ালি গানের সংস্কার করেন এবং এটিকে একটি প্রথাবদ্ধ রূপদান করেন। কাওয়ালি গান মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় উদ্ভূত সুফি ইসলামী ভক্তিমূলক গানের একটি রূপ। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এ গানের জনপ্রিয়তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি স্বতন্ত্র ধারায় পরিণত হয়েছে।
কাওয়ালি গানের ইতিহাস বাংলাদেশে ততটা সমৃদ্ধ না হলেও কিছু গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে কাওয়ালি গান ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিশেষত পুরান ঢাকা ও মোহাম্মদপুরে। তখন বিয়ে বাড়ি বা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও কাওয়ালি গান গাওয়ার রেওয়াজ ছিল। পুরান ঢাকায় সেহরির সময় কাসিদার পাশাপাশি মাইকে বাজতো ‘ভর দো ঝোলি মেরি ইয়া মোহাম্মাদি’, ‘ইয়ে মেরি মুর্শিদ, মেরি কামলিওয়ালা’-র মতো গান। এ সময় ঢাকার খুব নামকরা কাওয়াল ছিলেন চাঁদ রশিদ ও এহতেশাম রেজা খাঁ। এছাড়া আইয়ুব কাওয়াল, ছোট আইয়ুব, পিয়ারু কাওয়াল, আবদুল জব্বার ও হোসেন কাওয়াল জনপ্রিয় ছিলেন।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাওয়ালি গায়ক না হলেও তার কাজের মধ্যে রয়েছে কাওয়ালি ও ভক্তিমূলক গান। বাংলাদেশের কাওয়ালি গানগুলো সুফি রহস্যবাদ এবং আধ্যাত্মিক ভক্তির ওপর নির্ভর করে রচিত। এই ধরনের কাওয়ালি গানগুলো ধর্মীয় ও বিবাহ বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। কাওয়ালি গানের ধারাকে ৩ শতাব্দী ধরে লালন করছেন নুসরাত ফতেহ আলি খানের পরিবার। কাওয়ালি সংগীতের অন্যতম কালপুরুষ ধরা হয় ওস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলি খানকে। তার হাত ধরেই কাওয়ালি গান পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। পূর্বপুরুষ থেকে তার পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম প্রায় সবাই কাওয়ালি গানের ওস্তাদ।
"