নিজস্ব প্রতিবেদক
এনআইডি নিয়ে কারসাজির নেপথ্যে তারা ৪ জন
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার চার ক্ষমতাধরের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে নিতে সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছিল। এর নেপথ্যের চার কারিগর ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টার একজন শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, অপরজন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং বাকি দুজন হচ্ছেন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক পুলিশের আইজিপি বেনজীর আহমেদ। মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের নাগরিকের গোপনীয় তথ্য-ভাণ্ডারটি নিজেদের কবজায় নিতে রাষ্ট্রকে কাজে লাগিয়েছিলেন তারা। এমনকি মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে সংসদে আইন পাস করা হয়। খবর ইসি ও দায়িত্বশীল আমলা সূত্রের।
এদিকে, গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এরপর তখনকার নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে না দিতে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ সংক্রান্ত জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে চিঠি (ডিও লেটার) পাঠিয়েছেন ইসি সচিব। মঙ্গলবার ইসি সচিব শফিউল আজিম স্বাক্ষরিত ডিও লেটারটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জন বিভাগের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির কাছে পাঠানো হয়েছে।
ইসি ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এনআইডি সুরক্ষা বিভাগে নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল অসৎ এবং আর্থিক বাণিজ্যের আখড়া বানানোর জন্য। এ জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার কার্যালয়কে ব্যবহার করেছিল অসাধু চক্রটি। উদ্দেশ্য ছিল- আস্থাভাজন আমলা এবং পছন্দের বেকারদের সেখানে বসিয়ে এনআইডি নিয়ে রমরমা ব্যবসা করা। তবে কোটা সংস্কার ইস্যু থেকে সরকার পতনের পর সবকিছুতেই ছন্দপতন ঘটে। ফলে এনআইডি পুনরায় ইসিতে ফিরিয়ে আনতে কোমর বেঁধে নেমেছেন কর্মকর্তারা। তারা চাইছেন, ভোটার তালিকা আইনে সংশোধনী এনে এনআইডি স্থায়ীভাবে ইসির অধীনে রাখা। ইসি সচিবের পাঠানো চিঠিটি সেই বার্তার প্রাথমিক ধাপ বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। আর সাবেক সরকারের আস্থাভাজন কমিশন পদত্যাগ করায় ইসির কাছে এনআইডি ফিরিয়ে আনা সহজ হবে বলেও মনে করছেন দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনরত ইসির কর্মকর্তারা।
বঙ্গভবনে পাঠানো সচিবের চিঠিতে বলা হয়, ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লব ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে গত ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ফলস্বরূপ গঠিত অন্তর্র্বর্তী সরকার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নবযাত্রা শুরু করেছে। আপনি অবগত আছেন যে, ২০০৭-০৮ সালে দলমত নির্বিশেষে সবার আস্থার জায়গা থেকে ইসির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপিসহ ৯টি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ৮ কোটি ১০ লাখ নাগরিকের ডেমোগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহপূর্বক জাতীয়ভাবে ভোটার ডেটাবেইজ গড়ে তোলা হয়। সর্বশেষ প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুসারে এই ডেটাবেইজে প্রায় ১২ কোটি ১৯ লাখ নাগরিকের তথ্য রয়েছে। ইউএনডিপির সমীক্ষা অনুসারে ভোটারদের এই সংগৃহীত ডেটা ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ সঠিক বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, তৎকালীন সরকার সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ও গোপনীয় তথ্যসমৃদ্ধ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রম ইসির পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ছাড়া রুলস অব বিজনেস ভঙ্গ করে সুরক্ষা সেবা বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তকরণ করে বিগত সরকার। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগের মতামত গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ই ইসির মতামত গ্রহণ করা হয়নি।
উল্লেখ্য, এনআইডি কার্যক্রম স্থানান্তরে দ্বিমত জানিয়ে ২০২১ সালের ৭ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠিয়ে বিগত কমিশন তার অবস্থান সুস্পষ্ট করে। কিন্তু সেই মত উপেক্ষা করে গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ বাতিল করে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়। গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে উক্ত আইনটির কার্যকারিতার তারিখ নির্ধারিত না হওয়ায়, ইসির অধীনেই এখনো এনআইডি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ (১) অনুসারে ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে’। অন্যদিকে ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ এবং এতদসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশ অনুসারে ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩ নির্বাচন ব্যবস্থাপনা তথা ভোটার তালিকা প্রণয়নে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব হবে প্রণয়নের ক্ষেত্রে ডেটা প্রাপ্তির জন্য নির্বাচন কমিশনকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন নিয়োগ করা নিবন্ধকে সংবিধানে প্রদত্ত ইসির স্বাধীন অস্তিত্বের পরিপন্থি।
"